সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুন বলতে আসলে কী বোঝায় ?
সত্ত্ব, তমঃ ও রজঃ গুণ সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে এই তিনটি গুণ আসলে কী বোঝায়। বহু লেখায় সত্ত্ব, তমঃ ও রজঃ গুণের সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু অনেক সময়ই স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি যে এগুলি কী । সুতরাং, এই তিনটি গুণের সঠিক অর্থ বোঝা আমাদের জন্য জরুরি ।
সত্ত্ব শব্দের অর্থ হলো ধর্মীয় জ্ঞানের প্রকাশ । এটি থেকে উৎপন্ন হয়েছে ‘সাত্ত্বিক’ শব্দ, যার মানে হলো ধর্ম জ্ঞানী। সত্ত্ব শব্দটির মূল হলো ‘সৎ’, যার অর্থ হলো সাধু বা মহৎ। সুতরাং, সত্ত্ব বা সাত্ত্বিক বলতে আমরা বোঝাচ্ছি উন্নত জ্ঞানসম্পন্ন কিছু। যখন একজন ব্যক্তি সব পরিস্থিতিতে ধর্ম, সত্য ও ন্যায়ের বিচার করে আচরণ করেন, তখন তাকে সাত্ত্বিক বলা হয় ।
তমঃ শব্দটি অন্ধকারকে নির্দেশ করে এবং এটি থেকেই ‘তামসিক’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে । ভালো-মন্দের বিচার না করে জীবন যাপন করা কিংবা অন্ধভাবে কারো আদেশ পালন করাকে তামসিক আচরণ বলা হয় । যখন কেউ শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদা পূরণের জন্য জীবন যাপন করে, তখন সেটি তামসিক আচরণ হিসেবে বিবেচিত হয় ।
রজঃ শব্দের অর্থ অহঙ্কার বা গর্ব । রজোগুণী ব্যক্তিরা ধর্ম বা সত্যের জ্ঞান রাখলেও শরীর ও মনবাসনার দ্বারা আবদ্ধ থাকেন এবং অহঙ্কারপূর্ণ জীবনযাপন করেন । সংক্ষেপে বলতে গেলে, সত্ত্ব মানে ধর্ম জ্ঞান, রজঃ মানে অহঙ্কার এবং তমঃ মানে অন্ধকার ।
এই তিনটি গুণের সমন্বয়ে মানুষের সৃষ্টি । অর্থাৎ, প্রত্যেক ব্যক্তি এই তিনটি গুণের এক বা একাধিক নিয়ে গঠিত ।
মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে এই বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে বোঝানো যেতে পারে । উদাহরণস্বরূপ, দুর্যোধন ধর্ম জ্ঞান রাখলেও তা পালন করে না, ফলে তার সত্ত্ব গুণের অনুপস্থিতি রয়েছে । তার মধ্যে রজোগুণ অধিক, যা তাকে তমোগুণের দিকে টেনে নিয়েছে । এভাবে, দুর্যোধনের চরিত্রের মধ্যে তমোগুণের প্রভাব দেখা যায় ।
অন্যদিকে, ভীষ্মের মধ্যে অহঙ্কার নেই, তাই রজোগুণের অভাব রয়েছে; তবে ধর্ম জ্ঞান রয়েছে, তাই তার সত্ত্বগুণ আছে । এর ফলে, ভীষ্মকে তমোগুণের দ্বারা কিছু অজান্তেই অধর্ম করার জন্য বাধ্য করেছে ।
গীতার ১৭/৪ শ্লোকে বলা হয়েছে,
“যজন্তে সাত্ত্বিকা দেবান্ যক্ষরক্ষাংসি রাজসাঃ ।”
অর্থাৎ সাত্ত্বিক ব্যক্তিরা দেবতাদের, রাজসিক ব্যক্তিরা যক্ষ ও রাক্ষসদের, এবং তামসিক ব্যক্তিরা ভূত ও প্রেতদের পূজা করে ।
এখানে সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক শব্দগুলো ব্যক্তি বিশেষকে বোঝায়, কোনো খাদ্য বা বস্তুকে বোঝায় না ।
এভাবে আমরা গীতার বিভিন্ন শ্লোকের মাধ্যমে এই গুণগুলোর প্রকৃতি সম্পর্কে আরও গভীরভাবে বুঝতে পারি । খাবারের সাথে এই গুণগুলোর সংযোগ উল্লেখ করে গীতায় সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক শব্দগুলোর ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কিন্তু তা কোনো নির্দিষ্ট খাবার বোঝানোর উদ্দেশ্যে নয়; বরং ব্যক্তি বিশেষের গুণকে বোঝানোর জন্য । এইভাবে, সত্ত্ব, তমঃ ও রজঃ গুণের বৈশিষ্ট্যগুলি আমাদের জীবন ও আচরণের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং আমাদের চরিত্র গঠনে সহায়তা করে ।