হিন্দু ধর্মগ্রন্থ নিয়ে বিস্তারিত

0

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ নিয়ে বিস্তারিত

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা

(toc)

প্রত্যেক ধর্মেরই নিজস্ব ধর্মগ্রন্থ রয়েছে, হিন্দু ধর্মগ্রন্থেও অপর নাম শাস্ত্র। হিন্দু শাস্ত্রেও সংখ্যা অগণিত । হিন্দুধর্ম হল আদি ধর্ম, প্রাচীনতম ধর্ম। ঈশ্বরের স্বরূপ, জীবের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক, ঈশ্বর প্রাপ্তির উপায় ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় শাস্ত্র অধ্যয়ন থেকে জানা যায় । হিন্দু ধর্মে একাধিক ধর্মগ্রন্থ বা শাস্ত্র থাকলেও তার মধ্যে একখানা সিদ্ধশাস্ত্র হল বেদ ।

হিন্দু ধর্মের ঐতিহাসিক শ্রেণীবিন্যাস হলো শ্রুতি ও স্মৃতি

শ্রুতিঃ শ্রুতি শব্দের আক্ষরিক অর্থ যা শোনা হয়েছে এবং উপলব্দি করা যায় । সুপ্রাচীন কালের বৈদিক ঋষিরা কঠোর তপস্যা করে নিজেদের শুদ্ধ করেন । ঋষিদের ধ্যানে পাওয়া পবিত্র জ্ঞানই যে সব পবিত্র গ্রন্থরাজিতে ধরে রাখেন তারই নাম হল শ্রুতি । শ্রুতি মানুষের লেখা বই নয় বিধায় একে অপৌরুষেয় বলা হয়। শ্রুতিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়

  • বেদ
  • উপনিষদ

স্মৃতিঃ

স্মৃতি শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল যা মনে রাখা হয়েছে। শ্রুতির মত স্মৃতি অত প্রাচীন গ্রন্থ নয়। স্মৃতি মানুষের লেখা গ্রন্থ । স্মৃতির মধ্যে মানুষের জীবনবিধান ও ধর্মাচরণের পদ্ধতি লিপিবদ্ধ রয়েছে ।

স্মৃতিকে দুই ভাগে-ভাগ করা হয়

  • পুরাণ
  • মহাকাব্য

হিন্দু সমাজের তিন জন প্রধান আইন রচয়িতার নাম শোনা যায়

  • মনু
  • যাজ্ঞবল্ক্য ও
  • পরাশর

এদের গ্রন্থের প্রধান আলোচ্য বিষয় হল ধর্ম অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিকদের কর্তব্য । তাই এই গ্রন্থগুলিকে বলা হয় ধর্মশাস্ত্র ।

বেদঃ

প্রথমে বেদ অখন্ড ছিল, অনন্তর ভগবান্ বেদব্যাস তাকে ঋক্, সাম, যজুঃ ও অথর্ব এই চার খন্ডে বিভক্ত করেন । মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদ বিভাগ করেছিলেন বলেই তাঁর নাম হয় বেদব্যাস ।

হিন্দু ধর্মে বেদ চার প্রকার

  • ঋক্ বেদ- এটি সবচেয়ে পুরনো এবং বৃহৎ । ঋক্ বেদ প্রধানত ঋক বা প্রার্থনা মন্ত্রের সংকলন । বিখ্যাত গায়ত্রী মন্ত্র এর বেদের অংশ ।
  • সামবেদ- ঋক্ বেদের বাছাই করা কয়েকটি সূক্তে সুরারোপ করে কয়েকটি যজ্ঞের বিশেষ বিশেষ পর্যায়ে সেগুলি গান করার নির্দেশ দেওয়া আছে । ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের আদি উৎস হল এই সামবেদ ।
  • যজুর্বেদ- এই বেদে মূলত যাগযজ্ঞের নিয়মকানুন ।
  • অথর্ববেদ-পরবর্তীকালে রচিত এই বেদে রয়েছে নীতিতত্ত । ও আয়ুর্বেদ ইত্যাদি কয়েকটি বিজ্ঞানের বর্ণনা ।

বেদের প্রধান বিভাগ দুটি

  • মন্ত্র বা সংহিতা এবং
  • ব্রাহ্মণ

ক) মন্ত্র বা সংহিতাঃ সংহিতায় আছে মন্ত্র, এই অংশে লিপিবদ্ধ রয়েছে ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ, বিষ্ণু, রুদ্র প্রমুখ বৈদিক দেবতার বিভিন্ন মন্ত্র ও স্তবস্তুতি।

খ) ব্রাহ্মণঃ এই অংশে রয়েছে মন্ত্রের ব্যাখা ও যাগযজ্ঞের নিয়মকানুন। কোন যজ্ঞে কোন মন্ত্র উচ্চারণ করা দরকার, -তা জানা যায় ব্রাহ্মণ অংশে।

ব্রাহ্মণের আবার দুটি বিভাগ

১. আরণ্যক ও

২. উপনিষদ।

১) আরণ্যকঃ যা অরণ্যে রচিত তাকে আরন্যক বলে। আরণ্যকের বিষয় মূলত ধর্মদর্শন। আরণ্যক ব্রাহ্মণের অন্তিম অংশ। বনবাসী তপস্বীদের যজ্ঞভিত্তিক বিভিন্ন ধ্যানের বর্ণনা। গভীর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের বিষয় যাতে বর্ণনা করা হয়েছে, তাই আরণ্যক। ঐতরের আরণ্যক, বৃহদারণ্যক প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য আরণ্যক।

২) উপনিষদঃ উপনিষদ আরণ্যকের অন্তিম অংশ । এই অংশটিতে পরম সত্যের এক মরমিয়া ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে । পরম সত্যকে উপলব্দি করার শ্রেষ্ঠ পন্থাটিও উপনিষদুই আমাদের শিক্ষা দেয় । আরণ্যকে যে অধ্যাত্মবিদ্যার সূচনা, উপনিষদে তা বিস্তার ও গভীরতা লাভ করেছে ।

ব্রাহ্মণে বেদের কর্মকান্ড আর আরণ্যক ও উপনিষদে জ্ঞানকান্ড আলোচনা করা হয়েছে ।

পতঞ্জলির মহাবৈশ্যের মতে

  • ঋক্ বেদ ২১ টি শাখা
  • সামবেদ- ১০০০ টি শাখা
  • যজুর্বেদ- ১০১ টি শাখা
  • অথর্ববেদ-৯ টি শাখা

অর্থাৎ ১১৩১টি শাখা রয়েছে এর মধ্যে মাত্র ডজন খানের সহজলভ্য ।

বেদাঙ্গঃ ষড়ঙ্গ

বেদের মর্মার্থ উপলব্দি করার জন্য বেদের ৬টি অবয়বগ্রন্থ অধ্যয়নের প্রয়োজন । এই অবয়ব গ্রন্থগুলিকে বলা হয় -বেদাঙ্গ ।

বেদাঙ্গ শাস্ত্রগুলো হলোঃ

  1. শিক্ষা শিক্ষা বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে ধ্বনিতত্ত, বিশেষকরে উচ্চারণতত্ত সহ নির্ভুলভাবে বৈদিক শব্দ উচ্চারণের পদ্ধতিকে ।
  2. কল্প-যজ্ঞাদি কর্মকান্ড যার দ্বারা কল্পিত ও সমর্থিত হয় তাকে কল্প বলা হয় । 'কল্প' হচ্ছে নির্ভুলভাবে বৈদিক যাগযজ্ঞ ও ক্রিয়াকান্ড অনুষ্ঠানের পদ্ধতি ।
  3. ব্যাকরণ- ভাষাকে বিশ্লেষণ করে সূত্রায়িত করা এবং শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করা হয় । ভাষা ব্যবহারের সময় তার অর্থশুদ্ধির জন্য ব্যাকরণ পাঠ করা প্রয়োজন ।
  4. নিরুক্ত- বেদে ব্যবহৃত শব্দাবলির উৎপত্তি, অর্থ প্রভৃতির আলোচনা করা হয় ।
  5. ছন্দ- বেদের যে সকল মন্ত্র ছন্দবদ্ধ সেগুলোর অর্থবোধ এবং যথাযথ আবৃত্তির জন্য ছন্দের জ্ঞান অপরিহার্য ।
  6. জ্যোতিষ এখানে জ্যোতিষ বিষয়ক জ্ঞান আলোচনা করা হয়। যজ্ঞে ফল সিদ্ধির জন্য জ্যোতিষের আবশ্যক ।

উপবেদঃ

মূল বেদের সহকারী গ্রন্থ বলে এই শাস্ত্রগুলোকে উপবেদ বলে ।

  • আয়ুর্বেদ - ভেজষশাস্ত্র
  • ধনুর্বেদ - অস্ত্রবেদ
  • গন্ধর্ববেদ - সঙ্গীত বিদ্যা
  •  স্থাপত্যবেদ - কৃষিবেদ

উপনিষদঃ

উপনিষদ বলতে বোঝায় সেই গুহ্য ও পবিত্র জ্ঞান যা অজ্ঞানকে দূর করে পরম সত্য বা ব্রহ্ম সম্পর্কে অবহিত করায় এবং সেই ব্রহ্মজ্ঞানের মাধ্যমে আমাদের জাগতিক বন্ধনগুলিকে আলগা করে দেয় । উপনিষদ্‌ হল বেদের শেষ ভাগ; তাই এর অপর নাম 'বেদান্ত' । অন্য মতে, এটি বেদের সারাংশ বলে এর অপর নাম 'বেদান্ত' । এখানে 'উপ' অর্থ সমীপে বা নিকটে, 'নি' অর্থ নিশ্চয়, 'সদ্‌' ধাতুর অর্থ অবস্থান । অর্থাৎ গুরুর নিকটে বসে নিশ্চয়ের সঙ্গে যে জ্ঞান অর্জন করা হয় তাকে উপনিষদ বলে । কিন্তু এ কথায় উপনিষদের বিষয়বস্তু স্পষ্ট হয় না। জীবের মূলীভূত সত্তা হচ্ছে তার আত্মা । এই আত্মা পরমাত্ম বা ব্রহ্মেরই অংশ । সুতরাং জীব ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ব্রহ্ম নিরাকার । আত্মারূপে জীবের মধ্যে তাঁর অবস্থান । তিনিই সবকিছুর মূলে। এই ব্রহ্মজ্ঞান উপনিষদের বিষয়বস্তু ।

উপনিষদ অসংখ্য । তবে বর্তমানে ২০০ টির অধিক উপনিষদ পাওয়া যায় । বেদের বাইরেও উপনিষদের অস্তিত্ব রয়েছে। আদি শঙ্কারাচার্য ১০টি উপনিষদকে প্রাচীনতম ও প্রামাণ্য (বৈদিক) উপনিষদ হিসেবে গ্রহণ করেন ।

পরবর্তীকালে রামানুজ আরও ২টি নাম এই তালিকায় সংযুক্ত করেন ।

  1. ঈশ বা ঈশাবাস্য
  2. কেন
  3. কঠ
  4. প্রশ্ন
  5. মুডক
  6. মাণডুক্য
  7. ঐতরেয়
  8. তৈত্তরীয়
  9. ছান্দোগ্য
  10. বৃহদারণ্যক
  11. কৌষিতকী
  12. শ্বেতাশ্বেতর
  13. জাবাল
  14. কৈবল্য
  15. মহানারায়ণও
  16. বজ্রসূচিকা

কেবল মাত্র এই উপনিষদগুলিই পরম সত্যের ব্যাখ্যা প্রদান করে বলে এগুলোর গুরুত্ব বেশি। ভারতের জাতীয় নীতিবাক্য 'সত্যমেব জয়তে' মাণডুক্য উপনিষদ্‌ থেকে গৃহীত।

প্রস্থানত্রয়' উপনিষদ, গীতা ও ব্রহ্মসূত্র এই তিন' ধর্মগ্রন্থকে এক সঙ্গে বলা হয় 'প্রস্থানত্রয়'। হিন্দুদের প্রধান সম্প্রদায়গুলি প্রস্থানত্রয়কে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে । সম্প্রদায়ের প্রবর্তকেরা এগুলো ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে অদ্বৈত, দ্বৈত, বিশিষ্ট্যদ্বৈত ইত্যাদি মতবাদ প্রচার করেছেন

মহাকাব্যঃ

-ভারতবর্ষের প্রাচীন মহাকাব্য দু'টি মহাভারত ও রামায়ণ

গীতা বা শ্রীমদ্ভাগবদগীতা বা সংক্ষেপে গীতা হল হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতের একটি অংশ । এটি মহাভারতের ধর্মালোচনা মূলক অংশগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত । মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অর্ন্তগত ২৫-৪২ অধ্যায়গুলি গীতা নামে পরিচিত। গীতা-য় ৭০০টি শ্লোক আছে যা ১৮টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত করা হয়েছে । গীতা উপনিষদের সার । আর উপনিষদ্‌ শ্রুতির অবিচ্ছেদ্য অংশ । তাই গীতার প্রামাণিকতাও বেদের সমতুল্য। তাই গীতাকে প্রস্থানত্রয় বা তিনটি প্রামাণিক শাস্ত্রগ্রন্থের একটি মনে করা হয় ।

ব্রহ্মসূত্র

ব্রহ্মসূত্র উপনিষদ্‌ তথা বেদের অংশ নয়; এটি উপনিষদের সামগ্রিক ব্যাখ্যা। 'সূত্র' বা ছোটো ছোটো শ্লোকের আকারে এই বইটি লেখা। লিখেছিলেন ঋষি বাদরায়ণ। এই গ্রন্থের প্রধান আলোচ্য বিষয় হল পরমব্রহ্মের সঙ্গে মানব ও জগতের সম্পর্ক । তাই এর নাম 'ব্রহ্মসূত্র' । আবার বেদান্তের বাণীকে একসূত্রে বাঁধে বলে এর অন্য নাম 'বেদান্তসূত্র' । বইটি চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত । প্রতিটি অধ্যায় আবার চারটি করে পদে বিভক্ত । পদগুলি লিখিত হয়েছে একাধিক অধিকরণ নিয়ে। প্রত্যেকটি অধিকরণ এক একটি সূত্রের আকারে লেখা ।

সূত্রগুলি সাধারণ মানুষ যাতে বুঝতে পারে, তাই এগুলির একাধিক ভাষ্য লিখে গিয়েছেন পরবর্তীকালের দার্শনিক ও ধর্মতত্তবিদেরা । এঁদের মধ্যে আদি শঙ্কর, রামানুজ ও মঞ্চের নাম বিশেষভাবে উলেখযোগ্য । এঁদের রচনা থেকেই পরবর্তীকালে বেদান্তদর্শনের বিভিন্ন শাখাগুলির উদ্ভব ঘটে ।

শ্রুতি

শ্রুতি হিন্দুধর্মের প্রধান প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থ । কিন্তু এটিই আমাদের একমাত্র প্রামাণ্য গ্রন্থ নয় । শ্রুতির ভিত্তিতে পরবর্তীকালে এক দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রামাণ্য ধমগ্রন্থরাজি রচিত হয় । এগুলি 'স্মৃতি' নামে পরিচিত । স্মৃতি হল হিন্দুদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক আদর্শ আচরণবিধি । সহজ কথায় বললে, ধর্মীয় আইনের বই । হিন্দু সমাজে যুগে যুগে যেসব আইন রচিত হয়েছে, সেগুলির সংকলনই হল স্মৃতি। স্মৃতি বেদের মতো অপৌরুষেয় নয়; তা বেদকে ভিত্তি করে মানুষের দ্বারা রচিত এ কথা স্মৃতি নিজেও স্বীকার করে নিয়েছে। আসলে স্মৃতির উদ্দেশ্য হল শ্রুতির আদর্শগুলিকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে প্রয়োগ করার উদ্দেশ্যে অনুশাসন জারি করা । হিন্দু সমাজের তিন জন প্রধান আইন রচয়িতার নাম হল মনু, যাজ্ঞবল্ক্য ও পরাশর । এদের গ্রন্থের প্রধান আলোচ্য বিষয় হল ধর্ম অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিকদের কর্তব্য ।

তাই এই গ্রন্থগুলিকে বলা হয় 'ধর্মশাস্ত্র' । এই বইগুলিতে সমাজের প্রতিটি শ্রেণির মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য ব্যাখ্যার পাশাপাশি রাজার কর্তব্য, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, ফৌজদারি আইন, প্রাচীন কালের স্বাস্থ্যবিধি ও বিভিন্ন পাপের জন্য শাস্তি বিধানের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে অপৌরুষেয় নয় বলে, স্মৃতিতে পরিবর্তন আনতে খুব একটা বাধা পেতে হয় না । বরং যুগের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও আদর্শগত পরিবর্তনের সঙ্গে ধর্মজীবনকে খাপ খাওয়াতে এবং জাতীয় জীবনে উদ্ভুত নতুন সমস্যার সমাধান করতে স্মৃতিতে পরিবর্তন আনতেই হয় । এই পরিবর্তন অবশ্যই বেদকে অতিক্রম করে যায় না । শুধু প্রাচীন বিধিনিষেধগুলিকে বদলে, নতুন নিয়মকানুন চালু করা হয় । এর ফলে হিন্দুর জীবনযাত্রা ধর্মকে আঘাত না করেও যুগোপযোগী হয়ে ওঠে । হিন্দুধর্মের এও একটি বৈশিষ্ট্য । হিন্দুধর্ম স্থবির রক্ষণশীলের ধর্ম নয়; হিন্দুধর্ম যৌবনের ধর্ম । হিন্দু সমাজ একটি জীবন্ত সংস্থা । তাই এর আইনগুলিও নমনীয় । তাই যুগের প্রয়োজনে পুরনো আইন বাতিল করে, আমরা নতুন আইন রচনা করতে দ্বিধা করি না ।

এমন কী নতুন ধর্মশাস্ত্র রচিত হলে, তাকেও হিন্দুধর্ম স্বীকার করে নেয় ।

ইতিহাস ও পুরাণ

স্মৃতি ছাড়াও আরও কয়েকটি দ্বিতীয় পর্যায়ের ধর্মগ্রন্থ রয়েছে । এগুলি হলোঃ

  1. ইতিহাস
  2. পুরাণ
  3. আগম ও
  4. দর্শন

কখনও কখনও বৃহত্তর অর্থে স্মৃতি বলতে এই সব কটি ধর্মগ্রন্থকেই বোঝায় । কারণ, স্মৃতির মতো এগুলিও পরিবর্তনশীল । শ্রুতি যদি ধর্মের আত্মা ও স্মৃতি যদি তার দেহ হয়, তবে এই স্থগুলি হল অঙ্গপ্রত্যঙ্গমাত্র।

এবার আসুন, ইতিহাস ও পুরাণ নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করি ।

ইতিহাস রামায়ণ ও মহাভারত

প্রথমেই আসি 'ইতিহাস' প্রসঙ্গে। 'ইতিহাস' কাকে বলে? আমাদের দুটি অতি-পরিচিত মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত হল ইতিহাস । এই বই দুটি লেখার উদ্দেশ্য ছিল, নানা ঐতিহাসিক ও কিংবদন্তিকে অবলম্বন করে গল্পের মাধ্যমে বেদের সত্য ও স্মৃতির বিধানগুলিকে মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া । এই সব বইতে আমরা যে মহৎ চরিত্রগুলি দেখতে পাই, তাদের জীবনদর্শনই এদেশের মানুষের মনের মধ্যে হিন্দুধর্মকে দৃঢ়ভাবে গেঁথে দিয়েছিল । এক কথায় বলা যায়, রামায়ণ ও মহাভারত ছিল বেদের এক জনপ্রিয় ভাষ্য । বেদে আছে যাগযজ্ঞের বিস্তারিত বিবরণ আর ব্রহ্মতত্ত্ব সম্পর্কে গুরুগম্ভীর আলোচনা । এসবের মর্ম সাধারণ মানুষ ঠিক বুঝতে পারত না । তাই বেদের সত্যগুলিকে সকলের বোধগম্য করে গেঁথে দেওয়া হল মহাকাব্যের মধ্যে । আজও হিন্দুদের ধর্ম সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান হয় এই দুই মহাকাব্যের গল্প থেকে । রামায়ণ-রচিয়তা বাল্মীকি ও মহাভারত এর রচিয়তা ব্যাসদেবকে ঋষির মর্যাদা দেওয়া হয়। কারণ তাঁরা বেদের শিক্ষাগুলিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন । তাঁরা নিছক মহাকাব্য-রচনাকারী সাহিত্যিক ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন জাতির স্রষ্টা। তাঁদের শিক্ষা হিন্দুরা আজও মেনে চলে ।

রামায়ণ

মহর্ষি বাল্মীকি সংস্কৃত সাহিত্যে 'আদি কবি'র মর্যাদা পেয়ে থাকেন । বাল্মীকির রামায়ণ-এ মোট ২৪,০০০ শ্লোক আছে ।

রামায়ণ মোট সাতটি কান্ড বা অংশে বিভক্ত । এগুলি হলোঃ

  1. বালকান্ড-বাংলায় আদিকান্ড
  2. অযোধ্যাকান্ড
  3. অরণ্যকান্ড
  4. কিষ্কিন্ধ্যাকান্ড
  5. সুন্দরকান্ড
  6. যুদ্ধকান্ড (বা লঙ্কাকান্ড) ও
  7. উত্তরকান্ড

মহাভারত

মহাভারত হিন্দুধর্মের বিশ্বকোষ । কুরু বংশের দুটি শাখা পাব ও কৌরবদের গৃহবিবাদ এই উপাখ্যানের মূল উপজীব্য । কিন্তু এতে আছে দীর্ঘ উপন্যাস, সংলাপ, ধর্মালোচনা ও উপদেশমালা । বিষয়বৈচিত্রের জন্য একে বলা হয় 'পঞ্চম বেদ' । হিন্দুধর্মের এমন কোনো বিষয় নেই, যা মহাভারত-এ আলোচিত হয়নি ।

মহাভারত আঠারোটি পর্ব বা অংশে বিভক্ত। এগুলির নাম -হলোঃ

  1. আদি
  2. সভা
  3. বন
  4. বিরাট
  5. উদ্যোগ
  6. ভীষ্ম
  7. দ্রোণ
  8. কর্ণ
  9. শল্য
  10. সৌপ্তিক
  11. স্ত্রী
  12. শান্তি
  13. অনুশাসন
  14. অশ্বমেধ
  15. আশ্রমিক
  16. মৌষল
  17. মহাপ্রান্থনিক ও
  18. স্বর্গারোহণ ।

মহাভারত-এ এক লক্ষেরও অধিক শ্লোক রয়েছে । ভারতের বিভিন্ন ভাষায় রামায়ণ ও মহাভারত অনূদিত হয়েছে । হিন্দুদের ধর্মশিক্ষার বেশিরভাগটাই এই সব অনুবাদ গ্রন্থ থেকে হয়ে যায় । বাংলা ভাষায় রামায়ণ-এর প্রধান অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা এবং মহাভারত-এর প্রধান অনুবাদক কাশীরাম দাশ । দুজনেই আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ । কৃত্তিবাস ওঝা নদিয়া জেলার ও কাশীরাম দাশ বর্ধমান জেলার বাসিন্দা ছিলেন ।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
Post a Comment (0)
To Top