এই প্রশ্নের উত্তর গীতার ১৮ অধ্যায়ের ৪১ থেকে ৪৪ নং শ্লোকেই পাওয়া যায় । সেগুলো বলার আগে- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্রের সংজ্ঞা খুব সহজভাবে দেওয়া যাক, তারপর গীতার শ্লোকের সাথে সেগুলো মিলিয়ে নেবেন-
- ব্রাহ্মণ- যারা শারীরিক পরিশ্রম নয়, মাথা খাটিয়ে জীবিকা অর্জন করে ।
- ক্ষত্রিয়- যারা যেকোনো প্রকারে দেশ শাসন ও দেশ রক্ষায় নিয়োজিত ।
- বৈশ্য- যারা স্বাধীন পেশায় নিয়োজিত ।
- শুদ্র- যারা অপরের হুকুম মানতে বাধ্য ।
গীতার ১৮/৪২ নং শ্লোকে বলা হয়েছে-
"মনের শান্তি, ইন্দ্রিয় সংযম, তপস্যা, পবিত্রতা, ক্ষমা, সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সাত্ত্বিকী শ্রদ্ধা- এইগুলি ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম ।"
এগুলোর মধ্যে এখন জ্ঞান বিজ্ঞান ব্রাহ্মণকে চেনার একমাত্র উপায় । আর জ্ঞান বিজ্ঞান মস্তিষ্কের ব্যাপার, কায়িক পরিশ্রমের নয়, এজন্যই আমি এককথায় বলেছি- যারা শারীরিক পরিশ্রম নয়, মাথা খাটিয়ে জীবিকা অর্জন করে, তারা ব্রাহ্মণ। বর্তমান সময়ে ব্রাহ্মণজাত পেশার মধ্যে যেগুলো পড়ে, সেগুলো হলো- শিক্ষক, গুরু, চিকিৎসক, আইনজীবী বা এই ধরণের পেশাগুলো । এগুলোর মধ্যে গুরু, আইনজীবী এবং সরকারী চাকরি করে না এমন চিকিৎসক যথার্থই ব্রাহ্মণ; কারণ, এরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে । কিন্তু সরকারী বা বেসরকারী চাকরি করা চিকিৎসকরা পরিপূর্ণ ব্রাহ্মণ নয়, যেহেতু চাকরি করা হলো শুদ্রের কাজ ।
এরপর ১৮/৪৩ নং শ্লোকে বলা হয়েছে-
"শৌর্য, তেজ, ধৈর্য, কার্য দক্ষতা, যুদ্ধে পলায়ন না করা, দান করা, শাসন ক্ষমতা এইগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম ।
এই সূত্রে বর্তমানে ক্ষত্রিয়ের পেশাগুলি হলো- পুলিশ, সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, রাজনীতিবিদগণ এবং সরকারী চাকুরিজীবীরা । রাজা সম্রাটদের যুগে রাজপরিবারের লোকজন ছিলো হান্ড্রেড পার্সেন্ট ক্ষত্রিয়, বাকি সৈন্যরা যেহেতু ছিলো রাজ পরিবারের কর্মচারী, সেহেতু তারা ছিলো শুদ্র-ক্ষত্রিয় বৈশিষ্ট্যের। কিন্তু বর্তমান সময়ে গণতান্ত্রিক দেশে কেউ শুদ্ধ ক্ষত্রিয় নয়, যেহেতু রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই রাষ্ট্রের চাকরি করে ।
এরপর গীতার ১৮/৪৪ নং শ্লোকে বলা হয়েছে,
"কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য বৈশ্যের কর্ম এবং সেবাত্মক কর্ম শুদ্রের স্বভাবজাত ।"
ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় চিনতে অনেকেই ভুল না করলেও বৈশ্য ও শুদ্র চিনতে অনেকেই ভুল করে, যে কারণে অনেক বৈশ্য নিজেকে শুদ্র মনে করে, আর যারা প্রকৃতভাবেই শুদ্র, তারা যে শুদ্র, সেটা নিজেরাই জানে না ।
আমার সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞায় আমি বলেছি, যারা স্বাধীন পেশায় নিয়োজিত, তারা বৈশ্য । এর মানে হলো যারা অপরের চাকরি না ক'রে শারীরিক পরিশ্রম এবং নিজের জ্ঞানের মাধ্যমে জীবিকার ব্যবস্থা করে, তারা হলো বৈশ্য । বর্তমানে যেকোনো প্রকারের ব্যবসায়ী, সেটা চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সুপারস্টোর হোক বা সেটা নাপিত হোক, ধোপা হোক, মুচি হোক বা মেথর হোক বা হোক পাল বা ঘোষ এবং কৃষক, সবাই বৈশ্যের পর্যায়ে পড়ে । কারণ, এরা কারো হুকুম মানতে বাধ্য নয়, ইচ্ছে হলে কাজ করবে বা দোকান খুলবে, ইচ্ছে না হলে করবে না বা খুলবে না । কিন্তু যেকোনোভাবেই হোক, যাদের কোনো স্বাধীনতা নেই, যারা অপরের নির্দেশ মেনে কাজ করতে বাধ্য, সেটা কৃষিকাজে নিয়োজিত দিনমজুর হোক বা সরকারী আমলা হোক, সবাই শুদ্র। এর মধ্যে যাদের কাজে মাথা খাটানোর বেশি প্রয়োজন নেই শুধু শারীরিক পরিশ্রমে কাজ করতে হয়, তারা হান্ড্রেড পার্সেন্ট শুদ্র, কিন্তু যাদের কাজে মাথা খাটানোর প্রয়োজন আছে, যেমন অফিসে কর্মরত চাকুরিজীবীরা, তারা একটু উন্নত মানের শুদ্র; কারণ, এদেরকে নির্দেশ তো মানতে হয়, কিন্তু এদের শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় না, বলা যায় এরা ভদ্র শ্রেণীর শুদ্র ।
অনেকে নয় প্রায় সবাই, সামাজিক বাস্তবতায় মনে করে বর্ণবিভাগ জন্মসূত্রে, কিন্তু গীতায় বলা হয়েছে বর্ণবিভাগ কর্মসূত্রে; একারণেই গীতা ১৮/৪১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্রদিগের কর্মসকল স্বভাবজাত গুন অনুসারে ভাগ করা হয়েছে ।