সরস্বতী কি দুর্গার মেয়ে ?
আমরা অনেকেই মনে করি যে, লক্ষ্মী-সরস্বতী দুর্গার মেয়ে, এই ভাবনার কারণ হলো, কার্তিক গনেশ লক্ষ্মী সরস্বতীসহ দুর্গার পূজা শুরু হয় ভারতের কলকাতায় ১৬১০ সালে । দুর্গার সাথে একই কাঠামোয় কার্তিক গনেশ লক্ষ্মী সরস্বতীকে দেখে খুব সহজেই একটি পরিবারের চিন্তা মাথায় এসেই যায়, এই ভাবনা থেকেই আমরা মনে করে আসছি যে লক্ষ্মী, সরস্বতী দুর্গার মেয়ে এবং সঠিক তথ্য না জেনে সেই ভুল বিশ্বাসকেই আমরা শত শত বছর ধরে সঞ্চারিত করে এসেছি আমাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে । কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা নয়, তারা তিনজনই একই পদমর্যাদার দেবী; কারণ- সরস্বতী, লক্ষ্মী ও দুর্গা যথাক্রমে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের নারী শক্তি ।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা আলাদা কোনো সত্ত্বা নয়; ব্রহ্ম যখন সৃষ্টির কাজ করেন তখন তিনি ব্রহ্মা, যখন তিনি পালনের কাজ করেন তখন তিনি বিষ্ণু, আর যখন তিনি ধ্বংসের কাজ করেন, তখন তিনিই মহেশ্বর । একটি উদাহরণ দিলে এই ব্যাপারটি বোঝা আরও সহজ হবে; ধরে নিন, প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রীর হাতে তিনটি মন্ত্রণালয় আছে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বের পাশাপাশি ঐ মন্ত্রণালয়গুলোও দেখাশোনা করেন । এই অবস্থায় তিনি যে মন্ত্রণালয়ের হয়ে ফাইলে সই করেন বা করবেন, তখন কিন্তু তিনি সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, কিন্তু বাস্তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী । ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং ব্রহ্মের ব্যাপারটাও ঠিক সেই রকম । তাই যদি না হয় তাহলে বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার কৃষ্ণ, পালনের পাশাপাশি যুদ্ধ ও হত্যার মাধ্যমে পাপী ও দু্ষ্টদের বিনাশ করেছেন কেনো ? ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরকে যদি আলাদা আলাদা সত্ত্বা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের কাজ ছিলো শুধু পালন করা, তার তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বাঁধানোর কোন প্রয়োজন ছিলো না; প্রয়োজন ছিলো না শিশুকালেই রাক্ষসী ও অসুরদের, পরে কংস ও শিশুপালকে হত্যা করার এবং ভীমের মাধ্যমে জরাসন্ধ ও দুর্যোধনকে হত্যা করানোর ? আসলে কৃষ্ণ মানেই বিষ্ণু, আর বিষ্ণু মানেই পরমব্রহ্ম । এজন্য বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার হিসেবে শুধু মানবরূপী কৃষ্ণই নয়, প্রত্যেকটি মানুষ ই যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করে তখন এক অর্থে সে ই ব্রহ্মা, যখন কাউকে পালন করে তখন বিষ্ণু এবং যখন কাউকে ধ্বংস করে তখন শিব । এভাবে এবং এইসব রূপেই প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে পরমব্রহ্ম বাস করে । এজন্যই ছান্দোগ্য উপনিষদ (৩/১৪/১) ও বেদান্ত দর্শনে বলা হয়েছে,
“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”
অর্থাৎ, সকলের মধ্যেই ব্রহ্ম বিদ্যমান।
বা প্রচলিত কথায়, “যত জীব, তত শিব”।
আগেই উল্লেখ করেছি, ব্রহ্ম যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করে তখন তার নাম হয় ব্রহ্মা, আর যেকোনো কিছু সৃষ্টি করতেই লাগে জ্ঞান এবং প্রকৃতির নিয়ম হলো নারী ও পুরুষের মিলন ছাড়া কোনো কিছু সৃষ্টি হয় না, সৃষ্টি বলতে সাধারণ অর্থে এখানে মানুষকেই বোঝানো হচ্ছে, তো প্রকৃতির এই নিয়মকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই ব্রহ্মার নারীশক্তি হলো সরস্বতী, যাকে আমরা স্থূল অর্থে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে কল্পনা করে নিয়েছি; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে কিছু নেই, এমনকি ব্রহ্মা বলেও আলাদা কোনো সত্ত্বা নেই; লেখক কর্তৃক- গল্প, উপন্যাসে একাধিক চরিত্র সৃষ্টির মতো সবই ব্রহ্মের খেলা, এখানে ব্রহ্মই সবকিছু । যা হোক, কোনো কিছু তৈরি বা সৃষ্টি করতে হলে যেমন জ্ঞান লাগে, তেমনি সৃষ্টিকে নিখুঁত করার জন্য নজর রাখতে হয় চারেদিকে, এজন্যই কল্পনা করা হয়েছে ব্রহ্মার চারটি মাথা এবং তার নারীশক্তি সরস্বতীকে কল্পনা করা হয়েছে জ্ঞানের দেবী হিসেবে ।
এবার আসা যাক বিষ্ণুতে । বিষ্ণু হলো ব্রহ্মার পালনকারী রূপের নাম । তো কাউকে পালন করতে কী লাগে ? ধন-সম্পদ । এই জন্যই বিষ্ণুর নারী শক্তি হলো লক্ষ্মী এবং সে ধন-সম্পদের দেবী ।
এবার আসি শিব বা মহেশ্বরে । ব্রহ্মের ধ্বংকারী রূপের নাম শিব, মহেশ্বর বা রুদ্র । সৃষ্টি বা পালন করতে যেমন লাগে নারী শক্তি, তেমনি ধ্বংস করতেও লাগে নারী শক্তি । একারণেই রামায়ণের সীতা ও মহাভারতের দ্রৌপদীর জন্ম। এছাড়াও বিখ্যাত- গ্রীস ও ট্রয়ের মধ্যকার যুদ্ধের কারণও ছিলো এক নারী, নাম হেলেন । নারী শক্তি যেমন ধ্বংসের কারণ হতে পারে, তেমনি নারী নিজেও ধ্বংস করতে পারে। প্রকৃতির এই নিয়মকে স্বীকৃতি দিতেই ব্রহ্মের ধ্বংসকারী রূপ মহেশ্বর বা শিবের নারী শক্তি হলো দুর্গা, যার আরেক রূপের নাম কালী ।
সরস্বতী যে দুর্গার মেয়ে নয়, আশা করছি উপরের আলোচনায় বিষয়টি বোঝাতে পেরেছি ।