দোল বা হোলি উৎসব কী ও কেনো ?
ভারতীয় উপমহাদেশে- বাংলা এলাকার দোলই মূলত ভারতের অন্যান্য এলাকার হোলি; তবে বাংলা এলাকারও কোথাও কোথাও এটাকে একটু বিকৃত উচ্চারণে হুলি বলা হয়। দোল মূলত বৈষ্ণব সমাজের উৎসব; কারণ এই তিথিতেই চৈতন্যদেব জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। একদিকে এই তিথিতে চৈতন্যদেব জন্মগ্রহন করেছিলেন, অন্যদিকে এই তিথিতেই শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন বাসীর সঙ্গে প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী রং খেলায় মেতেছিলেন; এই সব কিছু মিলিয়ে রং খেলার পাশাপাশি বৈষ্ণব সমাজ এটাকে বানিয়েছে দোলযাত্রা।
এ সম্পর্কে দুটি কাহিনী প্রচলিত, একটি ‘হিরন্যকশিপু-প্রহ্লাদ-হোলিকা’র কাহিনী অন্যটি রাধা-কৃষ্ণের কাহিনী।
প্রথমে প্রথম কাহিনীটা ব’লে নিই, তাহলে পরের কাহিনীর মিথ্যাটা ধরতে সুবিধা হবে।
আপনারা অনেকেই জানেন যে, প্রচলিত Myth অনুযায়ী সত্যযুগে হিরণ্যকশিপু নামে এক রাজা ছিলো, যার ছেলের নাম ছিলো প্রহ্লাদ। এক সময় হিরণ্যকশিপু, দেবতাদের বরে বলীয়ান হয়ে নিজেকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ভাবতে শুরু করে এবং প্রজাদেরকে তাকে ঈশ্বর হিসেবে মানতে নির্দেশ দেয়। প্রজারা তো রাজার আদেশের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারে না, তাই সেই দিক থেকে সমস্যা ছিলো না, সমস্যা ছিলো ঘরের ভেতর নিজের বালক পুত্র প্রহ্লাদকে নিয়ে; কারণ, সে তার পিতাকে ঈশ্বর বলে মানতে রাজী ছিলো না। নিজের ছেলেই যদি তাকে ঈশ্বর বলে না মানে, তাহলে প্রজারা তাকে ঈশ্বর বলে মানবে কেনো ? অনেক বুঝিয়ে ছেলেকে ধর্মের পথ থেকে সরাতে না পেরে, হিরণ্যকশিপু পরিকল্পনা করে তাকে হত্যা করার এবং নিজের ছেলেকে হত্যা করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে কিন্তু প্রত্যেকবারই ব্যর্থ হয়।
শেষ পর্যন্ত হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা রাজাকে এই প্রস্তাব দেয় যে, বালক প্রহ্লাদকে হত্যা করার জন্য সে তাকে ধরে নিয়ে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করবে, যেহেতু হোলিকার উপর দেবতার এই বর ছিলো যে, আগুনে হোলিকার কোনো ক্ষতি হবে না, সেহেতু প্রহ্লাদ আগুনে পুড়ে মারা যাবে, কিন্তুর হোলিকার কোনো ক্ষতি হবে না।
হোলিকার প্রস্তাব মতো রাজা হিরণ্যকশিপু সেই ব্যবস্থা করে এবং তাতেও প্রহ্লাদ বেঁচে গিয়ে হোলিকাই আগুনে পুড়ে মারা যায়। এরপর রাজা হিরণ্যকশিপু, তার বালকপুত্রকে চ্যালেঞ্জ দেয়, তোমার ভগবান যদি থেকে থাকে তাকে এই মূহুর্তে এখানে উপস্থিত হতে বল, আর তারপর দেখ, তাকে আমি কিভাবে হত্যা করি। হিরণ্যকশিপু এটা বলা মাত্র, সেখানে নৃসিংহ বা নর সিংহ রূপে ভগবান বিষ্ণু আবির্ভূত হন এবং হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করে এবং আবার মিলিয়ে যান।
রাজ্যের প্রজারা, বালক প্রহ্লাদের এই ভগবান ভক্তি, অহঙ্কারী রাজার বিনাশ এবং ধর্মপ্রাণ প্রহ্লাদই যে এখন তাদের রাজা, এই খুশিতে আপ্লুত হয়ে উৎসব শুরু করে এবং রং যেহেতু উৎসবের আনন্দকে অনেকগুন বাড়িয়ে দেয়, সেহেতু প্রজারা রং নিয়ে খেলা শুরু করে; হোলিকা এবং হিরণ্যকশিপুর বিনাশ একই দিনে বা একই ঘটনায় ঘটেছিলো ব’লে কালক্রমে এই রং খেলার নাম হোলিকা থেকে শুধু হোলিতে পরিণত হয় এবং এ ঘটনার স্মরণে প্রতিবছর এই তিথিতে রং খেলা বা হোলি খেলা একটি উৎসবে পরিণত হয়ে যুগের পর যুগ ধরে চলতে থাকে এবং এখনও চলতে আছে।
এটাই হলো হোলি খেলার সূচনার মূল ঘটনা। কিন্তু পরবর্তীতে, বৈষ্ণব সমাজের অনেকেই, এই ঘটনাটিকে না জেনে, হোলি বা রং কেনো খেলা হয় এবং কোথা থেকে এই হোলি খেলার উৎপত্তি, এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য আশ্রয় নেয় রাধা কৃষ্ণের কাহিনীর, যেটা আপাত দৃষ্টিতে আপনার কাছে সত্য বলে মনে হবে, কিন্তু সনি আট চ্যানেলে প্রচারিত আদালত অনুষ্ঠান এর উকিল কে. ডি পাঠক, যার লক্ষ্য হলো সত্য উদঘাটন করা, তার দৃষ্টিতে দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন হোলির ব্যাপারে রাধা কৃষ্ণকে জড়িয়ে যা বলা হয়, তার পুরোটাই মিথ্যা।
হোলির সূচনা সম্পর্কে বৈষ্ণব সমাজ কর্তৃক, আড়ালে আবডালে প্রচারিত, রাধা-কৃষ্ণের কাহিনীটা আগে জেনে নিন, তার পর শুনবেন কে. ডি পাঠকের মতো আমার পর্যবেক্ষন ও বিশ্লেষণ :
বৈষ্ণব গুরুরা বলে- শ্রীকৃষ্ণ একদিন বৃন্দাবনে রাধা এবং তার সখীদের সঙ্গে খেলা করছিলেন। সে সময় হঠাৎ রাধার ঋতুচক্র শুরু হয় এবং রক্তে রাধার শাড়ি ভিজে গিয়ে সে এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। এই বিব্রতকর অবস্থা থেকে উদ্ধারে কৃষ্ণের মাথায় এক বুদ্ধি আসে, তিনি রাধার লজ্জা ঢাকতে রং নিয়ে খেলা শুরু করেন এবং রং এ সবাই মাখামাখি হয়ে গেলে কেউ বিষয়টি আর বুঝতে পারে না এবং এই ভাবে সেদিনের খেলা শেষ করেন। এই থেকেই রং বা হোলি খেলার উৎপত্তি।
কোনো মেয়ের ঋতুচক্র শুরু হলে, সেই সময় বা তার কিছু সময় আগে ঐ মেয়ের তলপেটে কিছু না কিছু ব্যথা অনুভূত হবেই এবং সে আর খেলার মুডে থাকবে না। ব্যথা হোক বা না হোক, পাবলিক প্লেসে ঋতুচক্র শুরু হলে সেটা সেখানে উপস্থিত যেকোনো ছেলের আগে কোনো এক মেয়ে সেটা বুঝতে বা জানতে পারবে, বা সেই মেয়ে কোনো এক মেয়ের সাথে সেটা শেয়ার করে বলবে, আমার এই অবস্থা, এখন আমি কী করবো ? বা বলবে, তোরা থাক, আমি বাড়ি গেলাম; বা বাড়ি যাওয়ার অজুহাত হিসেবে হয়তো বলতে পারে যে, শরীর ভালো লাগছে না বা কোনো কাজ আছে।
সুতরাং এই পরিস্থিতিতে কোনো অবস্থাতেই, সেখানে উপস্থিত একজন মেয়ের আগে, একজন ছেলে হিসেবে কৃষ্ণের জানার কথা নয় যে রাধা্র ঋতুচক্র শুরু হয়েছে। এই বিষয়টিই প্রমান করে যে, হোলির উৎপত্তি হিসেবে রাধা কৃষ্ণের যে গল্প বলা হয়, সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
এখন এখানে অজ্ঞ প্রতিপক্ষরা বলতে পারে যে, কৃষ্ণ ছিলো রাধার প্রেমিক এবং তাদের মধ্য খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো, সেক্ষেত্রে রাধা তার শারীরিক অবস্থার কথা কৃষ্ণকে বলতেই পারে এবং কৃষ্ণ, পুরো বিষয়টি আড়াল করার জন্য রং খেলার আয়োজন করতেই পারে।
এমনটা হতে পারে বা পারতো, যদি; যদি, রাধার বয়সটা ঋতুচক্র শুরু হওয়ার বা ঋতুচক্রকে কন্টিনিউ করার মতো হতো। সাধারণভাবে একটি মেয়ের ঋতুচক্র শুরু হওয়ার ১ বা ২ বছর পর, একটি মেয়ে বিষয়টাকে নরম্যালি নিতে পারে এবং সে সেই সিচুয়েশনটা তার মা বা অন্য কোনো মহিলার সাহায্য ছাড়াই হ্যান্ডেল করতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ যে অবস্থার কথা বলছে, তাতে রাধার বয়স কমপক্ষে ১৪/১৫ বছর হবে; কারণ এই বয়সের আগে বায়োলজিক্যালি কোনো মেয়ের পক্ষে প্রেমে পড়া সম্ভব নয় এবং এই বয়সেও একটি মেয়ের পক্ষে ঋতুচক্রের মতো একটি বিব্রতকর পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিয়ে বা সামাল দিয়ে রং খেলে যাওয়া সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে রাধার বয়স আরো বেশি হবে। কিন্তু ১৪/১৫ বা তারও বেশি বয়সে কৃষ্ণ তো বৃন্দাবনে ছিলোই না, তাহলে রাধার সাথে কৃষ্ণের এই ধরণের ঘটনা ঘটলো কখন এবং কিভাবে ?
কৃষ্ণের জীবনী থেকে আমরা জানি যে, ১০ বছর ২ মাস বয়সে কৃষ্ণ, মথুরা রাজা কংসকে হত্যা করার জন্য বৃন্দাবন থেকে মথুরায় চলে যান এবং তারপর তিনি আর কোনোদিন বৃন্দাবনে ফিরে যান নি। তাহলে যুবতী রাধার সাথে যুবক কৃষ্ণের দেখা কখন এবং কিভাবে হলো ? আর তাদের মধ্যে যদি দেখা ই না হয়, তাহলে তাদের মধ্য প্রেম কিভাবে হবে ? যদি কৃষ্ণের সাথে রাধা এবং তার সখীদের রং নিয়ে খেলা হয়েই থাকে, তাহলে সেটা হয়েছে, কৃষ্ণের বৃন্দাবন ছেড়ে যাওয়ার আগে, যখন কৃষ্ণের বয়স ছিলো ১০ বা তারও কম। বায়োলজিক্যাল সায়েন্স এর মতে, এই বয়সী একটি ছেলের মধ্যে প্রেমের সঞ্চার হতেই পারে না, তাহলে রাধার সাথে কৃষ্ণের প্রেমের কথা আসছে কোথা থেকে ? আর এই বয়সী একটা ছেলের পক্ষে মেয়েদের গোপন ব্যাপার স্যাপার সম্পর্কে ধারণাই থাকতে পারে না, তাহলে কৃষ্ণ, কিভাবে রাধার অবস্থা বুঝে রং খেলা শুরু করে, তাকে তার বিব্রত অবস্থা থেকে রক্ষা করবে ? আর গ্রামে বা শহরে, সবক্ষেত্রে, সমবয়সীদের সাথেই ছেলে মেয়েরা মিশে বা খেলা-ধূলা করে। তাহলে এটা ধরে নেওয়া যায় যে, রাধার বয়সও কৃষ্ণের সমানই ছিলো, তার মানে ঘটনার সময় রাধার বয়স ১০ বা ১০ এর কিছু কম ছিলো, তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ১০ বছর বয়সে একটা মেয়ের ঋতুচক্র কি শুরু হয় ? হয় না। সেক্ষেত্রে রং খেলার সূচনা নিয়ে রাধা-কৃষ্ণের যে ঘটনার কথা বলা হয়, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
রাধা-কৃষ্ণের ঘটনা থেকে যদি রং খেলার শুরু না হয়, তাহলে রং খেলার শুরু হয়েছিলো কিভাবে ?
কৃষ্ণ এবং তার বাল্যকালের খেলার অনেক সাথী, যার মধ্যে রাধাও একজন, এই সকলে মিলে যে রং খেলে নি, সেই দাবী কিন্তু আমি করছি না। পৌরাণিক কাহিনী মতে, আগুনে পুড়ে হোলিকা এবং বিষ্ণুর অবতার ভগবান নৃসিংহ কর্তৃক- হোলিকার ভাই ও প্রহ্লাদের পিতা- হিরণ্যকশিপু বধের পর প্রজাদের মধ্যে রং নিয়ে যে উৎসব শুরু হয়, সেই উৎসবকে স্মরণ করেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঐ নির্দিষ্ট তিথিতে বৃন্দাবনবাসীর সাথের রং খেলায় মেতে উঠেন; কারণ, বাল্য বয়সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একবার দেবী চণ্ডীর পূজা করেছিলেন, সুতরাং তার পক্ষে এরকম উদ্যোগ নেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তার মানে রং খেলার শুরুটা কৃষ্ণের থেকে নয়, প্রহ্লাদের থেকে।
সমগ্র বিষয় বিবেচনা করে, আদালত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, রং বা হোলি খেলার উৎপত্তি নিয়ে রাধা-কৃষ্ণের যে গল্প বলা হয়, সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং এটাও মিথ্যা যে কৃষ্ণের সাথে রাধা নামের কোনো মেয়ের প্রেম ছিলো, তাই এ সম্পর্কিত গল্প সমাজে প্রচার না করে প্রকৃত সত্যকে প্রচার করার জন্য সবাইকে বলা হলো এবং আজকের আদালতে এটাও প্রমানিত হয়েছে যে, রং বা হোলি খেলার উৎপত্তি কৃষ্ণের সময় নয়, হিরণ্যকশিপু বধের ঘটনার সময়।
Very Nice. I knew original story.
ReplyDelete