Table Of Content (toc)
শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী
১৫-১৬ শতকের আধ্যাত্মিক গুরু সমাজ সংস্কারক শ্রীচৈতন্য । অনুসারীদের মতে তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতার । শ্রীচৈতন্যর ধর্মীয় আন্দোলনের ফলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয় । হিন্দুধর্ম সংস্কারে তাঁর ভূমিকা অনন্য সাধারণ ।
জন্ম ও শৈশব লীলা
শ্রীচৈতন্য জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে । তাঁর পিতার নাম পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতার নাম শচীদেবী ।
জগন্নাথ মিশ্র ও শচীদেবীর জীবনে অনেক কষ্টের অভিজ্ঞতা ছিল । একে একে তাঁদের আটজন কন্যা অকালে মৃত্যুবরণ করে । তারপর একটি পুত্রসন্তান হয় । তাঁর নাম বিশ্বরূপ। তিনি যৌবনেই ঘর ছেড়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন । কথিত আছে, একদিন শচীদেবী ভগবানের চিন্তায় বিভোর হয়ে গঙ্গাস্নান করছিলেন । এমন সময় একটি তুলসীপাতা ভেসে এসে তাঁর নাভি স্পর্শ করে । এ ঘটনার কিছুদিন পর তাঁর এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয় । এই পুত্রের নাম রাখেন বিশ্বম্ভর । গৌর বর্ণের জন্য তাঁকে গৌর, গৌরচন্দ্র, গৌরাঙ্গও বলা হয় । তবে তাঁর ডাক নাম নিমাই । পরবর্তীকালে এই নিমাই-ই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বা চৈতন্যদেব নামে খ্যাত হন ।
নিমাইয়ের বয়স যখন ১০-১১, তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয় । মা শচীদেবী কনিষ্ঠ পুত্রকে নিয়ে খুব বিপদে পড়েন । বালক নিমাই ছিলেন খুবই চঞ্চল ও দুরন্ত । তবে তিনি যেমন দেখতে সুন্দর ছিলেন, তেমনি ছিলেন খুব মেধাবী । তাঁর মেধা এবং রূপের কারণে সকলেই তাঁকে স্নেহ করতেন । বিষ্ণু পণ্ডিত নিমাইকে হাতেখড়ি দেন । নিমাই গঙ্গাদাস পন্ডিতের চতুষ্পাঠীতে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন । বালক নিমাই পড়াশোনার প্রতি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান । তাই অল্পকালের মধ্যেই তিনি ব্যাকরণ, অলংকার, স্মৃতি ও ন্যায় শাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন । তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ প্রতিভার অধিকারী । যেখানেই তিনি গিয়েছেন সেখানেই লোকজনকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন । মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তিনি পণ্ডিত নিমাই হিসেবে সারা দেশে পরিচিতি লাভ করেন । এ সময় তিনি নিজেই একটি টোল খুলে ছাত্র পড়াতে লাগলেন । অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর অধ্যাপনার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে । মা শচীদেবী পণ্ডিত বল্লভাচার্যের কন্যা লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে নিমাইয়ের বিয়ে দেন । সে সময়ের প্রথা অনুযায়ী ছেলের বিয়েতে অনেক পণ নিতে পারতেন । কিন্তু শচীদেবী কোনো পণ নেননি ।
শিক্ষাজীবন
সে সময় কেশব মিশ্র নামে কাশ্মীরে এক বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন । তিনি কাশী, কাঞ্চী, দ্রাবিড়, নালন্দা প্রভৃতি স্থানের পন্ডিতদের শাস্ত্রবিচারে পরাজিত করে নবদ্বীপে আসেন । নবদ্বীপে এসে তিনি সেখানকার পণ্ডিতদের শাস্ত্রবিচারে আহ্বান জানান । তিনি সগর্বে ঘোষণা করেন, 'হয় তর্ক বিচার করুন, না হয় জয়পত্র লিখে দিন।' তাঁর পাণ্ডিত্যের কথা সবাই জানতেন । তাই তাঁর আহ্বানে নবদ্বীপের পণ্ডিত-সমাজ ভীত হয়ে পড়েন । তখন তরুণ পণ্ডিত নিমাই দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত কেশব মিশ্রের সম্মুখীন হন । গঙ্গাতীরে দুজনের মধ্যে কুশল বিনিময় হয় । নিমাইয়ের অনুরোধে কেশব মিশ্র তৎক্ষণাৎ মুখে মুখে শতাধিক শ্লোকে গঙ্গাস্ত্রোত্র রচনা করেন । আর নিমাই তখন শুরু করেন শ্লোকগুলোর সমালোচনা । তিনি কোন শ্লোকে কোথায় কী ভুল আছে তা ব্যাখ্যা করেন । নিমাইয়ের সমালোচনা শুনে উপস্থিত পণ্ডিতগণ বিস্মিত হন । কেশব মিশ্রও তাঁর ভুল স্বীকার করেন । এ ঘটনার পর নবদ্বীপে নিমাইয়ের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি আরো বেড়ে যায় ।
কিছুদিন পর নিমাই একবার পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে আসেন । নবদ্বীপে ফিরে গিয়ে শুনলেন, স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী সর্পদংশনে মারা গেছেন । স্ত্রীর মৃত্যুতে তিনি শোকাভিভূত হয়ে পড়েন । তাঁর মধ্যে সংসার-বিমুখতা দেখা দেয় । তিনি অত্যন্ত ধর্মানুরাগী হয়ে ওঠেন । এ বিষয়টি বুঝতে পেরে মা শচীদেবী সংসারের প্রতি আকৃষ্ট করতে সনাতন পন্ডিতের কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে নিমাইয়ের আবার বিয়ে দেন ।
কয়েক বছর সুখেই কাটে । ২২ বছর বয়সে যুবক চৈতন্য তাঁর মৃত পিতার আত্মার সদ্গতি কামনায় পিণ্ডদানের জন্য গয়ায় যান । সেখানে প্রখ্যাত বৈষ্ণব সাধক ও সন্ন্যাসী ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে নিমাই একাকী সাক্ষাৎ করেন । তিনি ঈশ্বরপুরীর নিকট কৃষ্ণনামে দীক্ষা নেন। এতে তাঁর মনে বিরাট পরিবর্তন আসে । নবদ্বীপে ফিরে অধ্যাপনা, সংসারধর্ম সব ছেড়ে দেন । শুধু কৃষ্ণনাম করেন। নবদ্বীপের বৈষ্ণবগণও তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন নিত্যানন্দ, শ্রীবাস, গদাধর, মুকুন্দ, অদ্বৈতাচার্য প্রমুখ । তাঁরা তাঁর প্রধান পার্ষদ। তবে নিত্যানন্দ ছিলেন সবচেয়ে কাছের । অনুসারীদের নিয়ে নিমাই বাড়ি-বাড়ি গিয়ে, এমনকি গ্রামের পথে পথে কৃষ্ণনাম প্রচার করতে থাকেন । এতে অবশ্য অনেকে ক্ষুব্ধ হন । অনেকে বাধাও দেন। জগাই-মাধাই নামে মাতাল দুই ভাই একদিন নিমাই ও নিত্যানন্দকে আক্রমণ করেন । কিন্তু নিমাই প্রেমভক্তি দিয়ে সবাইকে আপন করে নেন । তাঁরা সকলে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে নিমাইয়ের এ প্রেমভক্তির ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন ।
এদিকে সংসারের প্রতি নিমাইয়ের মন একেবারেই উঠে যায় । তিনি সংসার ত্যাগ করার কথা ভাবেন। তারপর মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের এক গভীর রাতে তিনি মা, স্ত্রী এবং ভক্তদের ছেড়ে গৃহত্যাগ করেন । কাটোয়ায় গিয়ে তিনি কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষা নেন । তখন তাঁর নতুন নাম হয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, সংক্ষেপে শ্রীচৈতন্য ।
শ্রীচৈতন্য তাঁর প্রেমভক্তির ধর্ম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান । পুরী, দাক্ষিণাত্য, বৃন্দাবন, কাশী প্রভৃতি স্থান ঘুরে তিনি জীবনের শেষ ১৮ বছর পুরীর নীলাচলে অতিবাহিত করেন । মাতৃভক্ত শ্রীচৈতন্য মায়ের অনুরোধে নীলাচলে থেকে জীবনের শেষ অবধি মায়ের খবরাখবর নেন । এ সময় শ্রীরূপ, সনাতন, রঘুনাথ ভট্ট, রঘুনাথ দাস, শ্রীজীব, গোপাল ভট্ট প্রমুখ বিশিষ্ট বৈষ্ণব পণ্ডিত তাঁর সঙ্গে ছিলেন ।
শ্রীচৈতন্যের কৃষ্ণপ্রেম দিন দিন আরও বাড়তে থাকে । পথে পথে তিনি 'কোথা কৃষ্ণ, দেখা দাও, দেখা দাও' বলে ঘুরে বেড়াতেন । শ্রীচৈতন্য প্রায়ই কৃষ্ণনামে উন্মাদ হয়ে থাকতেন । ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের আষাঢ় মাসে একদিন তিনি দিব্যভাবাবেশে আবিষ্ট হয়ে জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রবেশ করেন। হঠাৎ মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। সবাই বাইরে উন্মুখ হয়ে বসে থাকেন । তারপর দরজা খুলে তাঁকে আর দেখা যায়নি । ভেতরে শুধু জগন্নাথদেবের মূর্তি । ভক্তদের ধারণা, শ্রীচৈতন্য জগন্নাথদেবের দেহে লীন হয়ে গেছেন। শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্ধান নিয়ে বহু পণ্ডিতের বহু গবেষণা রয়েছে । তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো সর্বসম্মত মীমাংসা হয়নি ।
আরো জনুনঃ শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর মৃত্যু রহস্য
শ্রীচৈতন্যের আদর্শ
শ্রীচৈতন্য সকল মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন । তিনি মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ মানেননি । তিনি সমাজ থেকে জাতিভেদ প্রথা, সকল প্রকার ভেদাভেদ ও কুসংস্কার দূর করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন । সমস্ত সংকীর্ণতার ওপরে উঠে যেভাবে শ্রীচৈতন্য অস্পৃশ্যতা বর্জনের আহ্বান জানিয়ে মানুষে মানুষে সমভাবের কথা বলেছিলেন । সেকালে তা ছিল রীতিমতো বৈপ্লবিক পদক্ষেপ ।
তাঁর প্রেমভক্তির ধর্মে উচ্চ-নীচের কোনো স্থান ছিল না । তিনি সকলের প্রতি সমানভাবে স্নেহ ও ভালোবাসা বিতরণ করেছেন । তিনি সকলের সঙ্গে এক সারিতে বসে আহার গ্রহণ করেছেন । এভাবে তিনি হিন্দুসমাজকে নানা অবক্ষয় থেকে রক্ষা করেছেন । তিনি হিন্দুদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিভেদ, হানাহানিকে বহুলাংশে দূর করতে পেরেছিলেন৷ ।
তার প্রেমভক্তির কাছে জাতিভেদ ছিল না । সবাইকে তিনি প্রেম দিয়ে আপন করে নিয়েছিলেন । তাই তিনি বলেছেনঃ
যেই ভজে, সেই বড়, অভক্ত হীন ছাড়।
কৃষ্ণ ভজনে নাহি জাতি কুলাদি বিচার।।
উত্তম হঞা বৈষ্ণব হবে নিরভিমান।
জীবে সম্মান দিবে জানি কৃষ্ণ অধিষ্ঠান।
শ্রীচৈতন্যের অনুসারীদের প্রতিদিন কৃষ্ণবিষয়ক গ্রন্থ পাঠ করতে হতো । এ কারণে সেসময়ে শিক্ষার বিস্তার ঘটেছিল । পরবর্তীতে নারীশিক্ষায় শ্রীচৈতন্যের প্রভাব লক্ষ করা যায় । উনিশ শতকে বাংলার সম্ভ্রান্ত গৃহে মেয়েদের পড়ানোর জন্য বৈষ্ণবীরা আসতেন । বৈষ্ণবসমাজে নারীকে মর্যাদা দেওয়া হতো । এমনকি মেয়েরাও দীক্ষাদানের অধিকার পেয়েছিলেন । এ ক্ষেত্রেও চৈতন্যের প্রভাবই কাজ করেছে । চৈতন্যের প্রিয় ছিল কৃষ্ণনাম এবং কৃষ্ণবিষয়ক পদকীর্তন । আবার বৈষ্ণবের নিত্যকৃত্য ছিল কৃষ্ণকথা পাঠ ও শ্রবণ। তার ফলে চৈতন্যদেবের সময়ে এবং তাঁর পরবর্তী বাংলার বৈষ্ণব পদাবলি হয়ে উঠেছিল আধ্যাত্মিকতার ঐশ্বর্যে মণ্ডিত ।