শ্রীকৃষ্ণ কি ঈশ্বর ?
গীতার ৯/৪ এ বলা হয়েছে,
"আমি অব্যক্তস্বরূপে এই সমস্ত জগত ব্যাপিয়া আছি।সমস্ত ভূত আমাতে অবস্থিত, কিন্তু আমি তৎসমুদয়ে অবস্থিত নহি ।"
এই দুটো শ্লোকের ব্যাখ্যায় কিছু শ্রীকৃষ্ণ বিদ্বেষী বলেছে- গীতায় আমি বলতে যাকে বোঝানো হয়েছে, তিনি ঈশ্বর, যিনি অব্যক্তস্বরূপে পরিব্যাপ্ত । ঈশ্বর কোনো বস্তু বা প্রাণীর ভেতর অবস্থান করেন না। বরং তারা ঈশ্বরের ভেতরেই অবস্থিত, তাই কোনো প্রাণী বা বস্তুরূপে ঈশ্বরের উপাসনা করা বোকামি। তাই মানবরূপী শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নয় । তিনি কেবল যোগের মাধ্যমে পরমাত্মার সাথে যুক্ত হয়ে ঈশ্বরের কথাগুলোই অর্জুনকে বলেছেন। তার মানে আমি বলতে এখানে পরমাত্মাকে বোঝানো হয়েছে ।
-কিন্তু উপরে উক্ত ঐ দুটি শ্লোকে, শ্রীকৃষ্ণের- সমস্ত ভূত আমাতে অবস্থিত, কিন্তু আমি ততসমুদয়ে অবস্থিত নহি- বলার কারণ হলো-
ভূতসমূহের যেমন উৎপত্তি আছে, তেমনি তার বিনাশ আছে। শ্রীকৃষ্ণ যদি বলতেন আমি ভূতসমূহে অবস্থিত, তাহলে তার মানে দাঁড়াতো, ভূতসমূহের বিনাশের সাথে সাথে শ্রীকৃষ্ণেরও বিনাশ হয়ে যাবে, তখন এটা এমনিতেই প্রমাণিত হয়ে যেতো যে শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নন । কিন্তু সমস্ত ভূত আমাতে অবস্থিত, এই কথা বলে শ্রীকৃষ্ণ প্রমাণ করেছেন যে, সবকিছু তার থেকেই উৎপত্তি। এ প্রসঙ্গে এই কৃষ্ণ বিদ্বেষী যে বলেছে- ঈশ্বর কোনো বস্তু বা প্রাণীর ভেতর অবস্থান করেন না । তাই কোনো প্রাণী বা বস্তুরূপে ঈশ্বরের উপাসনা করা বোকামি।- এটা আসলে তার গীতার বাণীর মর্মকে উপলব্ধি না করার ফল ।
এরপর গীতার ৯/৪ এর শুরুতেই যে বলা হয়েছে, আমি অব্যক্তস্বরূপে এই সমস্ত জগত ব্যাপিয়া আছি, এর উপর ভিত্তি করে এই কৃষ্ণ বিদ্বেষী বলেছে, মানবরূপী শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নন, তিনি কেবল পরমাত্মার সাথে যোগেযুক্ত হয়ে অর্জুনকে গীতার জ্ঞান দান করেছেন, এখন দেখা যাক এই কথাটার কোনো সত্যতা আছে কি না ?
গীতার ৪/৬ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
"আমার জন্ম ও মৃত্যু নাই । আমি সকলের ঈশ্বর ।আমি নিজ প্রকৃতিকে আশ্রয় করিয়া নিজ মায়া বলে নিজেকে সৃষ্টি করিয়া থাকি।"
আবার গীতার ৪/৯ নং শ্লোকে বলেছন-
"হে অর্জুন, যিনি আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্ম প্রকৃতভাবে জানেন, দেহত্যাগ করিলে তাঁহার আর জন্ম হয় না, তিনি আমাকেই প্রাপ্ত হন।"
কৃষ্ণ বিদ্বেষীরা শ্রীকৃষ্ণকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে এবং শ্রীকৃষ্ণের জন্ম যে দিব্যজন্ম, যেটা তিনি গীতার ৪/৯ এ বলেছেন, সেটাকে স্বীকার করে না । আবার তারা এটাও বলে শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত হয়ে অর্জুনকে গীতার জ্ঞান দান করেছেন ।
যারা মনে শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত হয়ে গীতার জ্ঞান দান করেছেন, এটা আসলে তাদের ধারণা, বাস্তবে যার কোনো ভিত্তি নেই। কারণ,গীতার কোন কথা শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত আর কোনো কথা যোগমুক্ত অবস্থায় বলেছেন, সেই ব্যাপারে কোনো পরিসংখ্যান তাদের কাছে নেই। আবার শ্রীকৃষ্ণ কিভাবে যোগযুক্ত হন বা কিভাবে যোগমুক্ত হন, সেই পদ্ধতি সম্পর্কেও তারা কিছু বলতে পারে না । যোগযুক্ত বা যোগমুক্ত থিয়োরিকে স্বীকার করে নিলেও, এটা ধরে নিতে হবে যে- শ্রীকৃষ্ণ গীতার কথা হয় যোগযুক্ত অবস্থায় বলেছেন, নয়তো যোগমুক্ত অবস্থায় বলেছেন। একটি বাণী বা কিছু বাণী যোগযুক্ত অবস্থায় বলেছেন, আবার পরক্ষণেই এক বা একাধিক শ্লোক যোগমুক্ত অবস্থায় বলেছেন, এমনটা তো হতে পারে না । আগে আপনারা ক্লিয়ার করেন যে গীতার কোন কোন বাণী যোগযুক্ত এবং কোনো কোন বাণী যোগমুক্ত অবস্থায় বলা, তারপর এ ব্যাপারে আমার নিজের বক্তব্য পেশ করবো ।
আবার অনেকে এটা মনে করে যে শ্রীকৃষ্ণ একজন যোগীপুরুষ, ঈশ্বর নন; এই প্রেক্ষাপটে- গীতার কিছু শ্লোক আমি উল্লেখ করছি এবং সেই সাথে কিছু প্রশ্ন, ক্ষমতা থাকলে পয়েন্ট টু পয়েন্ট সেগুলোর জবাব দেবেন-
গীতার ৬/৪৭ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
"যিনি শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া মদগতচিত্তে আমার ভজনা করেন, যোগীদের মধ্যে তিনিই আমার সহিত যোগে সর্বাপক্ষো অধিক যুক্ত।"
- শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর না হয়ে সাধারণ যোগী পুরুষ হলে কি তিনি অপর কোনো যোগী পুরুষ সম্পর্কে এই ধরণের মন্তব্য করতে পারেন?
এরপর গীতার ৭/১ নং শ্লোকে বলেছেন-
"হে অর্জুন, তুমি আমাতে নিবিষ্টচিত্ত ও একমাত্র আমার শরণাপন্ন হইয়া যোগযুক্ত হইলে যেভাবে আমার সমগ্র স্বরূপ জানিতে পারিবে, তাহা বলিতেছি শোনো ।"
-একজন যোগী পুরুষ কি অপর একজন যোগীকে, তাতে নিবিষ্টচিত্ত এবং তাঁর শরণাপন্ন হতে বলতে পারেন?
এরপর গীতার ৭/২৫ নং শ্লোকে বলেছেন,
"আমি যোগমায়ায় সমাচ্ছন্ন থাকায় সকলের কাছে প্রকাশিত হই না। তাই মূর্খেরা জন্মমরণরহিত আমাকে পরমেশ্বর বলিয়া জানিতে পারে না ।"
-যোগ মানে ভগবানের সংকল্প, আর ভগবানের বশবর্তিনী যে মায়া, তাই যোগমায়া । পুরাণের বিষ্ণুই সনাতন ধর্মে বর্ণিত ঈশ্বর, আর বিষ্ণুর কল্পিত নারীশক্তি হলো লক্ষ্মী, তাই লক্ষ্মীর অপর নাম হলো যোগমায়া। বিষ্ণু যখন রাম রূপে পৃথিবীতে এসেছিলেন, তখন তার সহায়ক রূপে যোগমায়া এসেছিলেন সীতা রূপে । আবার বিষ্ণু যখন শ্রীকৃষ্ণ রূপে পৃথিবীতে এসেছিলেন (গীতা, ১১/২৪,৩০), তখন যোগমায়া একই সাথে- যশোদার শিশুকন্যা, পরে সুভদ্রা এবং রুক্মিণীরূপে এসে শ্রীকৃষ্ণের সহায়ক হন বাস্তবতার নিরীখে বা প্রয়োজনে । যোগমায়ায় সমাচ্ছন্ন থাকার মানে হলো- ঈশ্বরভাবে থাকা; তো কোনো সাধারণ পুরুষের পক্ষে কি এই কথা বলা সম্ভব যে- আমি যোগমায়ায় সমাচ্ছন্ন থাকি ?
এরপর শ্রীকৃষ্ণ গীতার অষ্টম অধ্যায়ে বলেছেন-
"বেদবিদগণ যাঁহাকে অক্ষর বলেন, অনাসক্ত যোগীগণ যাঁহাতে প্রবেশ করেন, যাঁহাকে লাভ করিবার জন্য ব্রহ্মচারিগণ ব্রহ্মচর্য অনুষ্ঠান করেন, আমি তোমাকে সংক্ষেপে সেই পরম পদ প্রাপ্তির উপায় বলিতেছি।"- (গীতা, ৮/১১)
"হে অর্জুন, যে যোগী অনন্যমনা হইয়া চিরদিন নিরন্তর আমাকে স্মরণ করেন, সেই সমাহিত যোগীর পক্ষে আমি সুলভ জানিবে ।"- (গীতা, ৮/১৪)
"মাহাত্মারা আমাকে পাইলে পরম সিদ্ধিলাভ করেন, তাই তাঁহারা আর এই দুঃখময় অনিত্য সংসারে পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হন না ।"- (গীতা, ৮/১৫)
"হে অর্জুন, ব্রহ্মলোক পর্যন্ত সমস্ত লোক হইতেই জীবসকল ফিরিয়া পুনরায় জন্মগ্রহন করে, কিন্তু আমাকে পাইলে আর পুনর্জন্ম লইতে হয় না ।"- (গীতা, ৮/১৬)
৮/১৪ তে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, "যে যোগী অনন্যমনা হইয়া চিরদিন নিরন্তর আমাকে স্মরণ করেন, সেই সমাহিত যোগীর পক্ষে আমি সুলভ জানিবে ।"
- শ্রীকৃষ্ণ একজন যোগীপুরুষ হলে কি তিনি অন্য যোগী সম্পর্কে এই ধরণের কথা বলতে পারতেন?
৮/১৫,১৬ তে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, তাকে লাভ করলে কাউকে আর পৃথিবীতে পুনর্জন্ম নিতে হয় না। এতে বোঝা যায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেই মুক্তিদাতা ঈশ্বর ।
আবার শ্রীকৃ্ষ্ণ গীতার ৯/২৭,২৮ নং শ্লোকে বলেছেন-
"হে অর্জুন, তুমি যাহা যাহা কার্য কর- ভোজন, হোম, দান, তপস্যা সে সবই আমাতে সমর্পণ করো । এই রূপে শুভ ও অশুভ ফলযুক্ত বন্ধন হইতে মুক্ত হইবে এবং আমাতে সর্বকর্ম সমর্পণরূপ যোগে যুক্ত হইয়া কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া আমাকেই প্রাপ্ত হইবে ।"
-এখানে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, "আমাতে সর্বকর্ম সমর্পণরূপ যোগে যুক্ত হইয়া কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া আমাকেই প্রাপ্ত হইবে ।"
অর্থাৎ ঈশ্বরে সর্বকর্ম সমর্পণ করাই হলো যোগে যুক্ত হওয়া এবং শ্রীকৃষ্ণ বলছেন তার সাথে যোগে যুক্ত হতে, শ্রীকৃষ্ণ শুধুমাত্র একজন যোগী পুরুষ হলে কি তিনি অর্জুনকে তার সাথে যোগে যুক্ত হতে বলতে পারতেন?
এরপর শ্রীকৃষ্ণ গীতার ১০ম অধ্যায়ের ৭ নং শ্লোকে বলেছেন-
"আমার এই বিভূতি ও যোগৈশ্বর্য যাঁহারা যথার্থরূপে অবগত, তাঁহারা নিশ্চয়ই যোগযুক্ত হন এবং আমাতেই সমাহিতচিত্ত হন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই ।"
-শ্রীকৃষ্ণ একজন সাধারণ যোগীপুরুষ হলে তিনি কি এটা বলতে পারতেন যে- তাঁহারা নিশ্চয়ই যোগযুক্ত হন এবং আমাতেই সমাহিতচিত্ত হন? খবরদার, এই কুযুক্তি দেবেন না যে, এই সময় শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত অবস্থায় ছিলেন; কারণ, গীতার কোনো বাণী যোগযুক্ত অবস্থায় বলা আর কোন বাণী যোগমুক্ত অবস্থায় বলা, এর সমাধান কিন্তু এখনও আপনারা দিতে পারেন নি । যে বিষয়ে যারা অজ্ঞ, সে বিষয়ে তাদের মন্তব্য করার কোনো অধিকার নেই বা অধিকার থাকে না ।
যা হোক, গীতার ১২/১১ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নির্দেশ দিয়েছেন এই বলে যে, "আমাতে কর্মার্পণরূপ যোগ আশ্রয় করিয়া সংযত চিত্ত হইয়া সকল কর্মের ফল ত্যাগ করো ।"
-একজন যোগী পুরুষ কি অপর কোনো যোগী পুরুষকে এই ধরণের নির্দেশ দিতে পারেন?
এই একই ধরণের নির্দেশ শ্রীকৃষ্ণ দিয়েছেন ১৮/৫৭ নং শ্লোকেও, এভাবে-
"তুমি মনে মনে সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পণ করিয়া মৎপরায়ণ হইয়া, সাম্য বুদ্ধির যোগ অবলম্বণ করিয়া, সর্বদা আমাতে চিত্ত রাখো এবং যথাধিকার কর্ম করিতে থাকো ।"
তাই এসংক্রান্ত প্রশ্নও আগেরটার মতোই- -একজন যোগী পুরুষ কি অপর কোনো যোগী পুরুষকে এই ধরণের নির্দেশ দিতে পারেন ?
এরপর গীতার ৯/২২ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
"যাঁহারা অন্য কামনা ত্যাগ করিয়া অনন্য চিত্তে আমারই চিন্তা করেন এবং আমারই উপাসনা করেন, সেই ভক্তদের জন্য আমি নিজে যোগ ও ক্ষেম বহন করিয়া থাকি ।"
- একজন যোগীপুরুষ কিভাবে অন্য যোগীর যোগ বহন করতে পারে ?
যা হোক, গীতার ১১/৪ নং শ্লোকে, অর্জুন- শ্রীকৃষ্ণকে "যোগেশ্বর" বলে সম্বোধন করেছে; আবার ১১/৯ নং শ্লোকে সঞ্জয়ও শ্রীকৃষ্ণকে যোগেশ্বর বলেছে, এর মানে কি শ্রীকৃষ্ণ একজন সাধারণ যোগীপুরুষ, যিনি যোগযুক্ত হয়ে নিজেকে ঈশ্বরের পর্যায়ে উন্নীত ভেবেছিলেন ?
গীতার ২/৫০ নং শ্লোকে বলা হয়েছে-
"যোগঃ কর্মসু কৌশলম" অর্থাৎ'কর্মে কৌশলই যোগ'।
এই কর্মে কৌশলে যিনি অঘটন ঘটন পটিয়সী, অর্থাৎ যিনি সব করতে পারেন, অর্থাৎ যিনি ঈশ্বর, তিনিই যোগেশ্বর । তাই যোগেশ্বর মানে যোগীর ঈশ্বরভাব ধরা নয়, ঈশ্বরের সকল কিছু করার ক্ষমতা ।