পিন্ডদান কি এবং কেন করা হয় ?
আত্মার স্বাতন্ত্র আছে । জীবাত্মার এই স্বাতন্ত্রবোধ আছে বলেই জড় শরীরে অবস্থানের কারনে ক্ৰমশ জড় আনন্দময় জীবন উপভোগের প্রতি আকৃষ্ট হয় । এভাবে ভগবদ্ বিমুখ হয়ে মায়াশক্তিতে আচ্ছাদিত হওয়ায় প্রকৃত স্বরূপ বিস্মৃত হয়ে ভগবানের সান্নিধ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে নানা রকম দুঃখ কষ্ট ভোগ করে। ফলে জন্ম জন্মান্তরেও মোক্ষলাভ করতে ব্যর্থ হয় ।
চিন্ময় জগৎ সম্বন্ধে কোন জ্ঞান না থাকায় সে জড় - জাগতিক আনন্দ উপভোগ করার জন্য জড় জগতে বারবার অধঃপতিত হয় । তাই প্রয়াত ব্যক্তির আত্মার উর্ধায়নের জন্য পিন্ড দান করতে হয় ।
গীতাতেও পিন্ডদানের কথা বলা আছে —
সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ।
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিন্ডোদকক্রিয়া।। ১/৪১
বর্নসঙ্কর অবাঞ্ছিত সন্তান উৎপাদন হলে সেই কুলে পিন্ডদান ও তর্পণ ক্রিয়া লোপ পাওয়ার ফলে পিতৃপুরুষেরা নরকে অধঃপতিত হয় ।
কর্মকান্ডের বিধি অনুসারে পিতৃপুরুষের আত্মাদের খাদ্যদ্রব্য এবং জল উৎসর্গ করা হয় । এই উৎসর্গ সাধন করা হয় বিষ্ণুকে পূজা করার মাধ্যমে, কারন বিষ্ণুকে উৎসর্গীকৃত প্রসাদ সেবন করার ফলে পাপ থেকে মুক্তি লাভ হয় ।
অনেক সময় পিতৃপুরুষেরা নানা রকমের পাপের ফল ভোগ করতে থাকে এবং অনেক সময় তাদের কেউ কেউ জড় দেহ পর্যন্ত ধারন করতে পারে না —সুক্ষ দেহে তারা প্রেতাত্মারূপে বিরাজ করে। যখন বংশের কেউ তার পিতৃপুরুষদের ভগবৎ প্রসাদ উৎসর্গ করে পিন্ডদান করে, তখন তাদের আত্মা তাদের পাপকর্ম থেকে মুক্ত হয়ে শান্তি লাভ করে । পিতৃপুরুষদের আত্মার সদগতির জন্য এই পিন্ডদান করাটা বংশানুক্রমিক রীতি । মহালয়ার পুন্য তিথিতে পূর্বপুরুষদের মঙ্গলার্থে অন্ন জল প্রদান করা হয় ।
আত্মা জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারন করে কিন্তু সেই দেহ গ্রহন পুর্বজন্মের কর্মের সংস্কারানুযায়ী হয় । দেহত্যাগের পর আত্মা সংস্কার দেহে বাস করে। পুর্ব জন্মকৃত অসৎ সংস্কার যদি থাকে তবে আত্মার মুক্তি ঘটে না, এমন কি জড় দেহ পর্যন্ত ধারন করতে পারে না, কষ্ট পায় প্রেতলোকে ।
কেউ যদি নিজ সাধনায় মুক্তি পায় তা শ্রেষ্ঠ মুক্তি। যারা তা পারে না অথবা আংশিক পারে তাদেরকে সহায়তা করা দরকার হয় । শ্রাদ্ধকার্য ইত্যাদি ঔর্দ্ধদেহিক ক্রিয়া হলো সহায়তা করা ।
তবে যে সমস্ত লোক ভক্তিযোগ সাধন করে না, তাদেরই কেবল এই রীতির অনুষ্ঠান করতে হয় । ভক্তিযোগ সাধন করার মাধ্যমে ভক্ত শতসহস্র পুর্বপুরুষের আত্মার মুক্তি সাধন করতে পারেন ।
শ্রীমদ্ভাগবতে (১১/৫/৪১) বলা হয়েছে —
দেবর্ষি ভূতাপ্ত-নৃণাং পিতৃণাং
ন কিঙ্করো নায়মৃণী চ রাজন্।
সর্বাত্মনা যঃ শরণং শরণ্যং
গতো মুকুন্দং পরিহৃত্য কর্তম্।।
‘যে সব কিছু ত্যাগ করে মোক্ষদানকারী মুকুন্দের চরণ কমলে শরণ নিয়েছে তার আর দেব-দেবী, মুনিঋষি, পরিবার-পরিজন মানব সমাজ এবং পিতৃপুরুষদের প্রতি কোন কর্তব্য থাকে না । পরমেশ্বর ভগবানের সেবা করার ফলে এই ধরনের কর্তব্যগুলি আপনা থেকেই সম্পাদিত হয়ে যায়' ।
তাই আত্মাকে এই জন্মেই সঠিক পথে পরিচালিত করুন যাতে করে আত্মা চিন্ময় জগত বা ভগবানের ধাম সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করে মোক্ষলাভের পথে অগ্রসর হতে পারে ।