কোনো হিন্দুকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, দেবী সরস্বতী কে ? বলবে, জ্ঞানের দেবী, বিদ্যার দেবী। আর ? আর কোনো তথ্য তার কাছে নেই । এরপর হয়তো দু’চার জন হিন্দু বলবে যে, সরস্বতী ব্রহ্মার স্ত্রী; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে কিছু নেই বা কিছু হয় না । তাহলে-
দেবী সরস্বতী কে ?
পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরের সৃষ্টিকারী রূপের নাম ব্রহ্মা আর ব্রহ্মার নারী শক্তির নাম সরস্বতী; এর মানে হলো সরস্বতীই ব্রহ্মা, আর ব্রহ্মা মানেই পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বর, অর্থাৎ সরস্বতীই পরমেশ্বর বা ঈশ্বর। অনেকেই সরস্বতীকে ছোটো দেবী হিসেবে মনে করে, প্রকৃতপক্ষে দেব-দেবীদের মধ্যে ছোট বা বড় বলে কিছু নেই, সব দেব-দেবী ই সমান; সুতরাং সরস্বতী, ঈশ্বরেরই একটা রূপের নাম এবং স্ত্রীলিঙ্গে স্বয়ং ঈশ্বরীরূপে সরস্বতীই পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বর ।
সরস্বতীর গায়ের রং সাদা কেনো ?
দেবী সরস্বতীর শুভ্র মূর্তি নিষ্কলুষ চরিত্রের প্রতীক; এটা এই শিক্ষা দেয় যে, প্রত্যেক ছেলে মেয়েকে হতে হবে নিষ্কলুষ নির্মল চরিত্রের অধিকারী; যে ছেলে মেয়েবাল্য কাল থেকে নিজেকে নিষ্কলুষ রাখার চেষ্টা করবে, সে যে সারা জীবন তার সকল কর্ম ও চিন্তায় নিজেকে নিষ্কলুষ রাখতে পারবে, তাতে তো আর কোনো সন্দেহ নেই ।
সরস্বতীর সাথে রাজহাঁস থাকে কেনো ?
রাজ হাসেঁর মধ্যে এমন ক্ষমতা আছে যে, এক পাত্রে থাকা জল মিশ্রিত দুধের থেকে সে শুধুমাত্র দুধ শুষে নিতে পারে । সরস্বতী যেহেতু শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট পূজা, সেই প্রেক্ষাপটে এটা বলা যেতে পারে যে, রাজহাসেঁর এই তথ্য শিক্ষার্থীদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, সমাজে ভালো মন্দ সবকিছুই থাকবে, তার মধ্যে থেকে তোমাদেরকে শুধু ভালোটুকু শুষে নিতে হবে । অধিকাংশ হিন্দু ছেলে-মেয়েরা যে মেধাবী এবং চরিত্রবান বা চরিত্রবতী, সরস্বতী পূজা এবং তার রাজহাঁসজনিত এই শিক্ষাই তার কারণ ।
সরস্বতীর হাতে বীণা থাকে কেনো ?
এর কারণ হচ্ছে-হিন্দুধর্ম হলো নাচ, গান সমৃদ্ধ শিল্পকলার ধর্ম; যা সামাজিক বাস্তবতাকে সম্পূর্ণভাবে সাপোর্ট করে । কারণ, প্রত্যেক ছেলে মেয়েই কোনো না কোনো প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহন করে; প্রকৃতির ধর্ম হিসেবে হিন্দুধর্ম এই সামাজিক বাস্তবতাকে স্বীকার করে, এই কারণেই দেবী সরস্বতীর হাতের বীণা হচ্ছে সেই শিল্পকলার প্রতীক । আর এটা সুধীজন স্বীকৃত যে, যারা- নাচ, গান, কবিতা লেখা বা নাট্যচর্চার মতো শিল্পকলার সাথে জড়িত, তারা সাধারণত কখনো মিথ্যাও বলে না; চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ তো দূরের ব্যাপার । সাধারণ ভাবে সকল হিন্দুই যে সৎ প্রকৃতির এবং প্রত্যেক হিন্দু ছেলে মেয়েই যে শিল্পকলার কিছু না কিছু না জানে, এটাই তার অন্যতম কারণ ।
সরস্বতীর হাতে পুস্তক থাকে কেনো ?
পুস্তক হলো জ্ঞানের ভাণ্ডার বা জ্ঞানের বাস হলো পুস্তকে । যেহেতু সরস্বতী হলো জ্ঞানের দেবী, তাই তার হাতে থাকে পুস্তক বা পূজায় পাঠ্যপুস্তক দিতে হয় । পৃথিবীতে হিন্দুরাই একমাত্র জাতি যারা জ্ঞানার্জনের জন্য পূজা প্রার্থনা করে । একারণেই হিন্দুরা একটি জ্ঞান পিপাসু এবং জ্ঞান সমৃদ্ধ জাতি। এখনও যেকোনো স্কুলে যে কয়জন হিন্দু ছাত্র ছাত্রী পাওয়া যাবে, দেখা যাবে তাদের মধ্যে ৯০% ই জিনিয়াস ।
সরস্বতীর দুই হাত না চার হাত ?
বর্তমানে দেবী সরস্বতীকে দুই হাত বিশিষ্ট দেখা গেলেও দেবী সরস্বতীর মূল মূর্তি আসলে চার হাত বিশিষ্ট, এরকম ছবি আপনারা অনেকে জায়গায় দেখলেও দেখে থাকতে পারেন, সরস্বতীর মূল থিমের সাথে এই চার হাত ই মানানসই; কারণ হলো- পড়াশুনার পাশাপাশি কেউ যদি নাচ গান বা অন্য যে কোনো শিল্পকলায় এক্সপার্ট হতে চায়, তাকে দুই হাতের শক্তি ও ব্যস্ততা নিয়ে কাজ করলে চলবে না, তাকে চার হাতের শক্তি ও ব্যস্ততা নিয়ে কাজ করত হবে ।
সরস্বতীর আসন, রাজহাঁস, না পদ্মফুল ?
অনেক কাঠামোতে দেখা যায়, সরস্বতী দেবী হাঁসের উপর বসে আছে আবার কোনো কাঠামোয় দেখা যায় পদ্মফুলের উপর; পদ্মফুলের উপ সরস্বতীর আসন ই সঠিক আসন । এর কারণ- পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মফুল হলো সফল ও সমৃদ্ধ জীবনের প্রতীক; এই কারণেই লেখা হয়েছে- “ফুলের মতো গড়বো মোরা মোদের এই জীবন” এই ধরণের কবিতা । এককথায় ফুলের বিকাশের সাথে মানুষের জীবনের বিকাশকে তুলনা করা হয়েছে । পূর্ণ বিকশিত একটি পদ্মফুলের উপর সরস্বতীর বসে থাকার মানে হলো- সরস্বতীর আদর্শকে লালন করে নিজের জীবনকে বিকশিত করতে পারলে সেই জীবনও ফুলের মতোই পবিত্র, সুন্দর, বিকশিত ও সমৃদ্ধ হবে ।
সরস্বতী কেনো মাতৃ মূর্তি ?
স্বয়ং ঈশ্বর হলেও সরস্বতী নারী মূর্তি অর্থাৎ মাতৃমূর্তি, এর কারণ হলো- পিতার চেয়ে মায়ের কাছে কোনো কথা বলা সহজ বা কোনো কিচু চাওয়া সহজ । সরস্বতীর পূজারীরা যেহেতু সাধারণভাবে শিশু বা বালক-বালিকা অর্থাৎ শিক্ষার্থী, তাই তারা যাতে সহজে নিজের মনের কথা নিজের মনের আকুতি, দেবী মায়ের কাছে জানাতে পারে, এজন্যই সরস্বতীকে কল্পনা করা হয়েছে মাতৃরূপে ।