বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভগবান
জড় ও চেতনার যে একটি উৎস ও নিয়ন্তা-শক্তি রয়েছে, সমগ্র মহাজগৎ তার স্বাক্ষর লিপিমালা ----অবিসংবাদিত প্রমাণ । নিউটন, আইনস্টাইনের মতো ক্লাসিক বিজ্ঞানী, থরো, ইমার্সনের মতো চিন্তাবিদ এ কথা স্বীকার করেছেন অনেক আগেই ।
টাইম-স্পেস-মোশন-গ্রাভিটেশান-ইলেক্ট্রোম্যা-গনেটিজম এই ম্যাটেরিয়াল ফিনোমেনা এবং কনশাসনেস বা চেতনা যা জড়ের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে - - - - উভয়ই এক পরা শক্তির, এক পরম বুদ্ধিমত্তার অধীন।
সেই মহাশক্তির প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়ে আইনস্টাইন সবিনয়ে বলেন
‘I try to comprehend an infinitesimal part of intelligence manifest in nature’---”
প্রকৃতিতে অভিব্যক্ত বিপুল বুদ্ধিমত্তার অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশমাত্র আমি উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি।” তিনি আরো বলেন—
"যখন আমি এই বিশ্ব জগতের চমৎকারিত্ব দেখি, তখন বিশ্বাস না করে পারি না যে এই সব কিছুর পেছনে একজন স্রষ্টার হাত আছে। আমি যত বেশি বিজ্ঞান পড়ছি, তত বেশি ঈশ্বরে বিশ্বাস করছি। "--—আলবার্ট আইনস্টাইন (পৃ ৯৭ বিজ্ঞান সনাতন ধর্ম ও বিশ্বসভ্যতা, গোবর্দ্ধনগোপাল দাস) ।
" এ সৌরজগৎ, গ্রহ-উপগ্রহ ও ধুমকেতুসমূহ একজন বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী স্রষ্টার সুপরিকল্পিত বিধান ও কর্তৃত্বেই কেবল পরিচালিত হতে পারে। যিনি সত্যিই পূর্ণহৃদয় দিয়ে গভীরভাবে ভাবেন, তাকে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেই হবে। "—আইজ্যাক নিউটন (পৃ ১০১) ।
লেসার ও মেসার আবিষ্কার করে নোবেল প্রাইজ প্রাপ্ত বিজ্ঞানী চার্লস টাউনস্ ২০০৫ এ বলেন, পরিকল্পক ভগবান শুধু একটি ‘শক্তি’ নয়, তিনি সবিশেষ ব্যক্তি :
“God is very personal, - - - - - I think there is continuous interaction between God and the universe, especially with us personally. That is very important in our lives.”
কে সেই মহাশক্তির অধীশ্বর পরম শক্তিমান, পরম বুদ্ধিমান? কেমন তাঁর ব্যক্তিত্ব? জড় বিজ্ঞান এর উত্তর খুঁজছে। কিন্তু অধ্যাত্ম বিজ্ঞানে স্মরণাতীত কাল পূর্বেই দেওয়া হয়েছে উত্তর। এ পর্যন্ত গতকাল আলোচনা হয়েছে। আজ অধ্যাত্ম বিজ্ঞান কি বলছে তা আলোচনা করা হলো ।
আদিত্যবর্ণ অর্থাৎ সূর্যের মতো জ্যোতির্ময় সনাতন পরমপুরুষ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ -----তিনিই সমগ্র জড়জগৎ, চিন্ময় জগৎ ও সকল জীবসত্তাসমূহের পরম উৎস, পরম কারণ ও পরম নিয়ন্তা।
এই তথ্য সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রের সারনির্যাস, সারসত্য। যেমন, ব্রহ্মসংহিতায় :—
ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দ বিগ্রহঃ।
অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম্।।
পরম ঈশ্বর হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি গোবিন্দ নামেও অভিহিত। তাঁর রূপ সচ্চিদানন্দময়, তিনি সচ্চিদানন্দ । এই জড় জগত তাঁর ইচ্ছাতেই সৃষ্টি হয়েছে । তিনিই এই জড় জগতের সমস্ত কিছুর পরম উৎস পরম পুরুষ । তিনি অনাদিরও আদি, তাঁর কোন উৎস নেই, তিনিই সব কিছুর উৎস, তিনি সমস্ত কারণের পরম কারণ । সব কিছুই ভগবান থেকে আসছে - - -জন্মাদস্য যতঃ (ভাঃ১/১/১)---যাঁর থেকে সবকিছু প্রকাশিত হয় ।
“এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্।
ইন্দ্রারিব্যাকুলং লোকং মূড়য়ন্তি যুগে যুগে।। ” (ভাঃ১/৩/২৮)।
সমস্ত অবতারেরা হচ্ছেন ভগবানের অংশ বা কলা অবতার, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং । যখন নাস্তিকদের অত্যাচার বেড়ে যায়, তখন আস্তিকদের রক্ষা করার জন্য ভগবান এই ধরাধামে অবতীর্ণ হন । তিনি পরম শক্তিমান, অসমোর্ধ্ব, শাশ্বত ব্যক্তিত্ব ‘ন তৎ সমশ্চাভ্যধিকশ্চ দৃশ্যতে’ (শ্বে.উপ. ৩/২৩)
শ্রীকৃষ্ণের রাজত্বকালে তাঁকে কেউই পরমেশ্বর ভগবান বলে চিনতে পারেননি । তবে চিনতে পেরেছিলেন শুধু একজন তিনি ভীষ্মদেব । আর কৃষ্ণ নিজে প্রকাশিত হয়েছিলেন এবং বিশ্ব রুপ দেখিয়েছিলেন শুধু অর্জুনকে । গীতার জ্ঞান প্রকাশিত হওয়ার পরই আজ এই কলিযুগের মানুষেরা তাঁকে ভগবান বলে চিনতে পেরেছে ।
জড় বস্তুর কোন ব্যক্তিত্ব নেই । কিন্তু যেখানেই চেতনার অস্তিত্ব, সেখানে চেতন সত্তা, চিৎকণা, সেখানেই রয়েছে ব্যক্তিত্ব । আর ব্যক্তিত্বের অর্থ, তার রূপ, নাম রয়েছে । সমস্ত চেতন সত্তার উৎস পরম চেতন বস্তু, সেজন্য পরম চেতনেরও ব্যক্তিত্ব রয়েছে ।
উৎসের যা থাকবে, উৎস থেকে বিনির্গত বস্তুর মধ্যেও থাকবে একই উপাদান । তারও থাকবে নাম, রূপ, ব্যক্তিত্ব। পার্থক্য হচ্ছে, জড়া প্রকৃতিতে আবদ্ধ বদ্ধজীবের জড় দেহগুলি তাদের আসল ‘স্বরূপ’ নয়, এগুলো নশ্বর পোশাক ।
পরমচেতন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, তাই তাঁকে বলা হয় পরমপুরুষ। তিনি জড়া প্রকৃতির নশ্বর পোষাক পরিগ্রহ করেন না। তাঁর রূপ, নাম, ব্যক্তিত্ব শাশ্বত ও নিত্য, অজড়, চিন্ময় । একই সাথে তিনি তাঁর শক্তির মাধ্যমে সর্বব্যাপ্ত। ভগবান পরম শক্তিমান, জড় শক্তি ও চিৎশক্তি তাঁর অধীন । শক্তি স্বাধীন নয়, শক্তিমানের আয়ত্তাধীন। তাই গীতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমপুরুষ বা পরমেশ্বর যা বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করছেন যে, পরিকল্পক ভগবান শুধু একটি শক্তি নন এক সবিশেষ ব্যক্তি ।