'ন তস্য প্রতিমা অস্তি' এর সঠিক ব্যাখ্যা

0

'ন তস্য প্রতিমা অস্তি' এর সঠিক ব্যাখ্যা

যজুর্বেদের একটি শ্লোকের খন্ডাংশ -“ন তস্য প্রতিমা অস্তি” এটার অর্থ করে বলা হয় "তাঁর কোন প্রতিমা নেই" । এই খন্ডাংশটি নিয়ে অনেক পন্ডিত ব্যক্তিরাও একথাই বলে থাকেন। এটার উপর ভিত্তি করে বলা হয় প্রতিমা পূজার কথা বেদে নেই।

তাহলে আমরা যে ভগবান বা বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিকৃতি নির্মাণ করে পূজা করি, সেটা কি ঠিক নয়? আসলে শ্লোকটির অর্থ যা এখানে বলা হয়েছে তা সঠিক নয়। সেটা ভুল। যাদের বেদ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা নেই এবং বৈদিক অভিধান যে ভালভাবে পড়েনি বা উপলব্ধি করেনি, তারা যজুর্বেদ আর শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের দুটি শ্লোকের মাঝখানের কিছু অংশ তুলে ধরে এর কদর্থ করে বলে থাকে পরমেশ্বর ভগবানের কোন প্রতিকৃতি নেই।

প্রকৃতপক্ষে “প্রতিমা” একটি সংস্কৃত শব্দ। এ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ‘প্রতিম’ থেকে এবং আ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে তার উচ্চারণ হয়েছে প্রতিমা। এই 'প্রতিম' শব্দের অর্থ তুলনীয়,যেমন অগ্রজপ্রতিম, ভ্রাতৃপ্রতিম ইত্যাদি। আর প্রতিম থেকেই প্রতিমা শব্দটি এসেছে। তাই “ন তস্য প্রতিমা অস্তি” শ্লোকাংশটির অর্থ হলো তাঁর কোন তুলনা নেই। আরো ভেঙে বলতে গেলে তাঁর তুল্য কেউ নেই। তিনি অসমোর্ধ্ব তিনি অতুলনীয় বা তাঁর সমান কেউ নেই।

সংস্কৃতে একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ আছে। সেক্ষেত্রে এই শ্লোকের সামনে পিছনের অর্থাৎ পুরো শ্লোকের অর্থ থেকে এর প্রয়োগের উপর ভিত্তি করে আমাদের দেখতে হবে যে, কোন অর্থে সেটি ব্যবহৃত হয়েছে।

"ন তস্য প্রতিমা অস্তি" এর সঠিক ব্যাখ্যা

পুরো শ্লোকটা হলো —

শুক্ল যজুর্বেদ— ৩২/৩

ন তস্য প্রতিমা অস্তি যস্য নাম মহৎযশঃ
হিরণ্যগর্ভ ইত্যেষ মা মা হিংসীদিত্যেষা
যস্মান্ন জাত ইত্যেষ ।।

তাঁর কোন তুলনা নেই, যার মহৎ যশ আছে, তিনি হিরণ্যগর্ভ, তাঁর প্রতি অসূয়পরায়ন হয়ো না, তাঁর থেকে ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতাগন জাত, তিনি স্বরাট। ‘তাঁর তুলনা বা সাদৃশ্য নাই যাঁর নামে মহৎ যশ ৷’একথাই কি যশস্বীকে বলা শোভা পায় না যে ‘আপনার তুল্য আর কেহ নাই’ ?

এই কথাগুলো থেকে তাঁর কোন প্রতিমা নেই এটা বুঝায় না, বুঝায় তাঁর কোন তুলনা নেই। এখানে প্রতিমা অর্থ তুলনা। আর একটু সহজ ভাবে বললে বলা যায়, যেমন আমরা বলে থাকি লোকটি খুব জ্ঞানী গুণী ধার্মিক এটা বলে পরে বলে থাকি তার কোন তুলনা নেই তার কোন প্রতিমা নেই বলিনা।

"ন তস্য প্রতিমা অস্তি" এই খন্ডাংশটি আর একটা শ্লোকে রয়েছে। সেটা হলো —
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ — ৪/১৯
নৈন মূর্ধবং ন তির্যঞ্চং ন মধ্যে পরিজগ্রভৎ
ন তস্য প্রতিমা অস্তি যস্য নাম মহৎযশঃ ।।
কেউ তাঁর আদি, মধ্য, অন্ত উপলব্ধি করতে পারে না। তিনি গ্রাহ্যাতীত বস্তু, তাঁর কোন উপমা নেই, তাঁর নাম অনন্ত মহিমাপূর্ন।। এখানেও "ন তস্য প্রতিমা অস্তি" এর আগে পরে শব্দগুলো থেকে বুঝা যায় তাঁর কোন তুলনা নেই।
ন তস্য প্রতিমা অস্তি— এটার উপর ভিত্তি করে বলা হয় প্রতিমা পূজার কথা বেদে নেই। প্রতিমা বা প্রতিমূর্তি নেই বলে এই খন্ডিত শ্লোকের অর্থ করে যা বলা হয় তা সম্পুর্ণ ভুল এবং তাঁর যে প্রতিমা বা প্রতিমূর্তী আছে তা নীচের শ্লোকগুলো থেকে নিশ্চয়ই প্রমাণ হয়।
শ্রীঈশোপনিষদ ১৫নং মন্ত্র
হে প্রভূ, হে সর্বজীব পালক, আপনার উজ্জ্বল জ্যোতির দ্বারা আপনার প্রকৃত মুখারবিন্দ আচ্ছাদিত। কৃপা করে সেই আচ্ছাদন দূর করুন এবং আপনার শুদ্ধ ভক্তের নিকট নিজেকে প্রদর্শিত করুন।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩ /৩
সর্বত্র চোখ বিশিষ্ট তথা সর্বত্র মুখ বিশিষ্ট, সর্বত্র হস্তবিশিষ্ট এবং সর্বত্র পদ বিশিষ্ট, স্বর্গ ও মর্তের সৃষ্টিকর্তা সেই একমাত্র পরমেশ্বর প্রানীকূলকে হস্ত, ডানা ইত্যাদি প্রদান করেছেন।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/১৪ ও ঋকবেদ ১০ মন্ডল ৯০/১
সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু, সহস্র পদ বিশিষ্ট সেই পরম পুরুষ সমগ্র ব্রহ্মান্ডকে পরিব্যাপ্ত করেও দশ অঙুলি পরিসরের মধ্যে অবস্থান করছেন।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/১৬
সর্বত্র হস্তবিশিষ্ট, সর্বত্র নেত্রবিশিষ্ট, সর্বত্র মস্তক ও মুখবিশিষ্ট, সর্বত্র কর্ণ বিশিষ্ট সেই পরমাত্মা এই বিশ্ব চরাচরের সব কিছুতেই পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/২০
সুক্ষ্ম থেকেও সুক্ষ্মতর এবং মহৎ থেকেও মহত্তর সেই পরমাত্মা জীবের হৃদয়রূপ গুহায় বিরাজমান রয়েছেন। তাঁরই কৃপায় কোনো ভাগ্যবান জীব দুঃখ ও শোক থেকে মুক্ত হয়ে তাঁকে দর্শন করতে সক্ষম হন।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪/৩
তুমি স্ত্রী, তুমি পুরুষ, তুমিই কুমার অথবা কুমারী। তুমিই বৃদ্ধরূপ ধারণ করে লাঠির সাহায্যে চল। আবার তুমিই বিরাট রূপে প্রকট হয়ে সর্বদিকে মুখবিশিষ্ট হয়ে যাও।
প্রতিমা কি দ্বারা তৈরী হবে তাও বলা আছে
শ্রীমদ্ভাগবত— ১১/২৭/১২
শৈলী দারুময়ী লৌহী লেপ্য লেখ্য চ সৈকতী
মনোময়ী মনিময়ী প্রতিমাষ্টবিধা স্মিতা।
এই আট প্রকার দ্রব্য দ্বারা প্রতিমা তৈরি করতে হয়।
পদ্মপুরান
অর্চ্যে বিষ্ণু শিলাধীঃ
যস্যৎ নারকীঃ সঃ।
শ্রী বিষ্ণুর বিগ্রহকে শিলা মনে করা অপরাধ।
উপরের শ্লোকগুলো প্রমাণ করে তাঁর প্রতিমা বা প্রতিমুর্তী আছে। তাই "ন তস্য প্রতিমা অস্তি" এই খন্ডাংশটি দিয়ে প্রতিমা নেই বলে যা বলা হয় তা সঠিক নয়, সম্পুর্ন ভুল।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
Post a Comment (0)
To Top