হিন্দুধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

0
হিন্দুধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

Table Of Content (toc)

হিন্দুধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

হিন্দুধর্মের অপর নাম সনাতন ধর্ম । বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত ধর্মসমূহের মধ্যে এই সনাতন ধর্ম তথা হিন্দুধর্ম একাধারে প্রাচীন এবং নবীন । প্রাচীন এ কারণে যে, সনাতন ধর্ম তার সনাতন ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। আর নবীন এ কারণে যে, সনাতন ঐতিহ্য বজায় রেখেও এ ধর্ম যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলছে। এ ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে কোনো একক ব্যক্তিবিশেষকে চিহ্নিত করা যায় না। এ ধর্মের মূলে রয়েছেন ভগবান স্বয়ং । সৃষ্টির আদিকাল থেকে এ ধর্মমতের পরিচয় মেলে। দীর্ঘ যাত্রাপথে ধর্মের মূলতত্ত্বকে ধরে রেখেও নতুন নতুন ধর্মীয় চিন্তা গ্রহণ করে এ ধর্ম ক্রমশ পল্লবিত হয়েছে এবং হচ্ছে। সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পার নিদর্শন থেকে হিন্দুধর্মের কিঞ্চিৎ পরিচয় ও ধারণা পাওয়া যায়। আর্যরা এদেশের বহিরাগত সম্প্রদায় । তারা যখন ভারত ভূমিতে আসে তখন তাদের সঙ্গে ছিল নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি। এদেশের প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে আর্য সভ্যতার সংঘর্ষ এবং পরিণতিতে সিন্ধুসভ্যতার সঙ্গে আর্য সভ্যতার একটা সমন্বয় ঘটে। এর ফলে হিন্দুধর্মের ধর্মচর্চার সঙ্গে আর্যদের ধর্মবিশ্বাস মিলিত হয়ে একটা নতুন রূপ ধারণ করে । কালক্রমে এটি আর্যসভ্যতা, আর্যধর্ম নামে প্রাধান্য লাভ করে। এই ঐতিহাসিক পটভূমিকায় স্থিত সনাতন ধর্ম তার নতুন অভিধায় পরিচিত হওয়া শুরু করে। আর্যগণ সুপ্রাচীন সিন্ধুনদের তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করতে থাকে। বহিরাগত আফগান ও পার্সিক সম্প্রদায় সিন্ধুনদকে হিন্দুনদ বলে উচ্চারণ করত। তাদের উচ্চারণে সিন্ধুর 'স' পরিবর্তিত হয়ে 'হ'-তে রূপ নেয় এবং সিন্ধু শব্দটি হিন্দু বলে উচ্চারিত হতে থাকে । তাই অনেক গবেষকের মতে সিন্ধু শব্দ থেকেই হিন্দু শব্দের উৎপত্তি এবং সিন্ধু নদের তীরবর্তী লোকদের ধর্মই হিন্দুধর্ম বলে আখ্যায়িত হয়। সনাতন ধর্ম ক্রমে হিন্দুধর্ম নামে পরিচিতি লাভ করে । তবে সময়ের অগ্রগতিতে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের অনুষঙ্গী হিসেবে সনাতন ধর্মের চিন্তা- চেতনায় নতুনত্বের সংযোজন ঘটে । হিন্দুধর্মের এই বিকাশমান বৈশিষ্ট্যটি তিনটি স্তরে বিন্যস্ত করে দেখা যায়— বৈদিক যুগ, পৌরাণিক যুগ ও আধুনিক যুগ ।

বৈদিক যুগ

বেদ হিন্দুধর্মের আদি ধর্মগ্রন্থ । বৈদিক ধর্মগ্রন্থসমূহের রয়েছে চারটি ভাগ : সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ। সংহিতা ও ব্রাহ্মণভাগ নিয়ে বেদের কর্মকাণ্ড, আবার আরণ্যক ও উপনিষদ ভাগ দুটি নিয়ে বেদের জ্ঞানকাণ্ড। বেদের সংহিতা অংশে ইন্দ্ৰ, অগ্নি, সূর্য, বরুণ, ঊষা, রাত্রি প্রভৃতি দেব-দেবীৰ স্তব-স্তুতি রয়েছে। বেদের মন্ত্র উচ্চারণ করে দেবগণের উদ্দেশে যাগযজ্ঞ করে অভীষ্ট লাভের প্রার্থনা করা হতো। বেদ-মন্ত্রগুলো রহস্যময় । সাধারণের জ্ঞানে এর তাৎপর্য অনেক সময় ধরা পড়ে না । তবে যাগযজ্ঞের অনুশীলন করে আর্যগণ দুইটি বস্তুর প্রতি প্রার্থনা জানাতেন। বস্তু দুইটি হচ্ছে- শ্রী ও ধী।


শ্রী অর্থাৎ ধন-ধান্য, বল-বিক্রম, যশ ইত্যাদি পার্থিব কাম্যবস্তু। ধী হচ্ছে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। আবার বেদের অন্য কতগুলো মন্ত্রের বিষয়বস্তু বুদ্ধি, জ্ঞানজ্যোতিঃ, অমৃততত্ত্ব। এ দুইটি চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে হিন্দুধর্মের মূল তত্ত্বটি প্রকটিত হয়েছে। ধর্মের সংজ্ঞায় জানা যায় যা থেকে জাগতিক কল্যাণ এবং পারমার্থিক মঙ্গল লাভ হয় সেটিই ধর্ম । এটি সনাতন তথা হিন্দুধর্মের মূল ভিত্তি । বৈদিক যুগের ঋষিদের ধর্মীয় চিন্তাচেতনায় জাগতিক এবং পারমার্থিক উভয়বিধ কল্যাণ অর্জনের উদ্দেশ্য ছিল । বৈদিক যুগে ঋষিগণ ছিলেন সুখবাদী, জীবনবাদী। বাজসনেয় সংহিতায় বলা হয়েছে-

তেজোঽসি তেজো ময়ি ধেহি ।

বীর্যমসি বীর্যং ময়ি ধেহি ।

বলমসি বলং ময়ি ধেহি।

ওজোহস্যোজো ময়ি ধেহি।

মন্যুরসি মন্যুং ময়ি ধেহি।

সহ্যোৎসি সহ্যং ময়ি ধেহি ।


অর্থাৎ তুমি তেজস্বরূপ, আমাকে তেজ দাও, আমাকে তেজস্বী কর। তুমি বীর্যস্বরূপ, আমায় বীর্যবান কর । তুমি বলস্বরূপ, আমায় বলবান কর । তুমি ওজঃস্বরূপ, আমায় ওজস্বী কর। তুমি মন্যু স্বরূপ (অন্যায়দ্রোহী), আমায় অন্যায়দ্রোহী কর । তুমি সহ্যস্বরূপ (সহ্যশক্তি), আমায় সহনশীল কর ।

বৈদিক যুগের প্রার্থনায় দেখা যায় জীবনে সমৃদ্ধি, জীবের প্রতি স্নেহ-প্রীতি এবং জগতের শান্তি কামনা । এই প্রার্থনাগুলোর মধ্য দিয়ে এক পরমশক্তি ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করা হয়েছে। একে ঈশ্বরবাদ বলা যায় । এখানে উল্লেখ্য, বৈদিক যুগে ধর্মানুষ্ঠানের রূপ ছিল যজ্ঞক্রিয়া। যজ্ঞকর্মের অনুশীলন করে মানুষ অভীষ্ট কর্মফল লাভ করতে পারতেন। এটিকে পরবর্তীকালে বলা হলো যাগ-যজ্ঞাদি কাম্যকর্ম, জীবের সংসার বন্ধনের কারণ । এগুলো মোক্ষলাভের সহায়ক নয়। যজ্ঞকর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হলে যজ্ঞকারীর অভীষ্ট ফল লাভ হয়, এমনকি স্বর্গপ্রাপ্তিও ঘটে। কিন্তু পুণ্য ক্ষয় হলে জীবকে স্বৰ্গভোগ ছেড়ে পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় । মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈশ্বর লাভ বা মোক্ষলাভ। বৈদিক যুগের জ্ঞানপ্রধান উপনিষদ ও দার্শনিক চিন্তার পর্যায়ে এসে তৎকালীন ঋষিগণ উপলব্ধি করেন, মোক্ষলাভই জীবনের উদ্দেশ্য আর এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য কাম্যকর্ম পরিত্যাগ করে সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করতে হবে । এখানে সনাতন ধর্মচিন্তায় নতুন উপলব্ধি এসে যায় । মোক্ষলাভের সহায়ক ধর্মচিন্তায় সন্ন্যাসবাদের আবির্ভাব ঘটে । এ স্তরে মুক্তিলাভের পথ প্রদর্শক হিসেবে বহু উপনিষদ গ্রন্থ রচনা হয়। এ পর্যন্ত দুইশতেরও অধিক উপনিষদের পরিচয় জানা গেছে। তবে কৌষিতকী, ঐতরেয়, ছান্দোগ্য, ঈশ, কেন, কঠ, তৈত্তিরীয় প্রভৃতি বারোটি উপনিষদকে প্রধান ও প্রামাণ্য উপনিষদ বলা হয়। এগুলোর মধ্যেও পরস্পর মতভেদ রয়েছে । ব্রহ্মলাভের পথ সুগম করার উদ্দেশ্যে মহর্ষি বাদরায়ণ বেদব্যাস 'ব্রহ্মসূত্র' গ্রন্থে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন । একেই বলা হয় বেদান্ত দর্শন ।

এখানে উল্লেখ্য, ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ, ভেদবাদ, অভেদবাদ, ভেদাভেদবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদের উত্থান ঘটে এবং হিন্দুদর্শন-চিন্তায় এক সমৃদ্ধ যুগের আবির্ভাব ঘটে । বৈদিক যুগের ধর্মচিন্তায় কাম্যকর্ম মোক্ষদায়ক নয়। তাই বেদান্তের ব্রহ্মচিন্তা হিন্দুধর্মের চিন্তাজগতে এক পরিবর্তন ধরা পড়ে ।

এভাবে সনাতন ধর্মের দুইটি শাখা প্রকট হয়ে ওঠে; একটি কর্মমার্গ, অপরটি জ্ঞানমার্গ


স্মৃতিশাস্ত্র বা ধর্মশাস্ত্র

বৈদিক শিক্ষার কর্ম ও জ্ঞান এ দুই মতের সংযোগ স্থাপন করে সৃষ্টি হয় স্মৃতিশাস্ত্র । এখানে এসে জানা যায় মোক্ষলাভের জন্য কর্ম ও জ্ঞান উভয়েরই প্রয়োজন রয়েছে। হিন্দুদের জীবনচর্চার আশ্রম বিভাগে জানা গেছে, প্রথম পঁচিশ বছর ব্রহ্মচর্য আশ্রমে বিদ্যা শিক্ষা ও সংযম শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। এর পরের পঁচিশ বছর গার্হস্থ্য আশ্রমে ধর্ম সংযুক্ত অর্থ, কাম, সেবা আচরণীয়। পরে বানপ্রস্থ আশ্রমে মুনিবৃত্তি অবলম্বন এবং সন্ন্যাস আশ্রমে কর্ম ত্যাগ করে ব্রহ্মচিন্তায় নিমজ্জন । এখানে প্রথম দুই আশ্রমে কর্মযোগ এবং শেষের দুই আশ্রমে জ্ঞানযোগের পরিচয় মেলে। স্মৃতিশাস্ত্রে হিন্দুসমাজ পরিচালনার বিধি-বিধানও সন্নিবেশিত রয়েছে। এভাবে হিন্দুধর্মে জাগতিক এবং পারমার্থিক চিন্তার ক্রমশ বিকাশ ঘটতে থাকে ।

পৌরাণিক যুগ

পৌরাণিক যুগে হিন্দুধর্মের চিন্তা জগতে ভক্তির প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। বেদ ও উপনিষদের মধ্যেও ভক্তিভাবের ইঙ্গিত রয়েছে। এটি পৌরাণিক যুগে এসে বিশেষ বৈশিষ্ট্য লাভ করে । আর ভক্তিমার্গের প্রাধান্য লাভ করায় সনাতন ধর্মে এক রূপান্তর সংঘটিত হয় । ভক্তিকে অবলম্বন করে পরম তত্ত্বে উপনীত হওয়ার যাত্রাপথে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রকাশ ঘটে। দেবতা একাধিক, তাই পরব্রহ্মের স্থান নিয়ে বিভিন্ন দেব-দেবীর অনুসারী ভক্তগণের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয় ।

হিন্দুধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

এভাবে বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত প্রভৃতি সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। আর হিন্দুধর্মের অবতার পুরুষদের মাহাত্ম্য কীর্তনে বিভিন্ন পুরাণ ও উপপুরাণ প্রণীত হয় । বিষ্ণুপুরাণ, শিবপুরাণ, কর্মপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ, ভাগবতপুরাণ এবং বেশকিছু উপ-পুরাণও এই যুগে রচিত হয়। বৈষ্ণব ধর্মে বিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণ ভগবান হিসেবে পূজিত হন । আবার বৈষ্ণব ধর্মমতের মতো আর একটি প্রভাবশালী ধর্মমত হলো শৈব ধর্মমত। তাদের মতে শিবই সমস্ত আগমশাস্ত্রের বক্তা ।

আবার বিশ্বচরাচরে সর্বত্র শক্তির প্রকাশ । ব্রহ্ম বস্তুকে যখন সগুণ, সক্রিয় বলে ধারণা করা হয় তখনই তাঁর শক্তির চিন্তা এসে পড়ে; কেননা শক্তিরই প্রকাশ হয় ক্রিয়াতে। শক্তি ও শক্তিমান অভিন্ন। যেমন অগ্নি ও তার দাহিকা শক্তি । দাহিকা শক্তি ছাড়া অগ্নির কল্পনা অসম্ভব । অনুরূপভাবে শক্তি ব্যতীত শক্তিমানের কর্মক্ষমতা থাকে না । সুতরাং শক্তিও পরম আরাধ্য ।

এই যে বৈষ্ণব, শৈব, শাক্তমতের উল্লেখ করা হলো, এসব মতের সবগুলোতেই সগুণ ঈশ্বর, জগতের সত্যতা এবং ভক্তিমার্গের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করা হয়েছে । বৈদিক কর্মবাদ ও বেদান্তের নির্গুণ ব্ৰহ্মবাদ থেকে পৌরাণিক ধর্মসমূহের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। শাস্ত্রবচন থেকে জানা যায়, বিষ্ণু, রুদ্র, শক্তির দেবী- এঁরা সবাই এক মূলতত্ত্বের প্রকাশ বা বিকাশ – 'একং সদ বিপ্রা বহুধা বদন্তি'। এক ব্রহ্মকেই মনীষীরা বিভিন্ন নামে ও রূপে অভিহিত করেন। ধর্মচর্চার অবলম্বন হিসেবে ভক্তি সনাতন সাধনার চিন্তাজগতে এক বিশেষ পরিবর্তন ঘটিয়েছে । এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতার প্রসঙ্গটি স্মরণ করা যায়। ভক্তিপথে ঈশ্বর আরাধনার বিশেষ আহ্বান আছে শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতায় । এ গ্রন্থটিতে হিন্দুধর্মের সাধন প্রক্রিয়াগুলোর কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি প্রভৃতি বিষয় সংরক্ষিত ও সমন্বিত রয়েছে । ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদার আহ্বানে হিন্দুধর্মের সমন্বয়-চেতনা বিবৃত হয়েছে ।

গীতার ভক্তিবাদের প্রকাশ বিভিন্ন পর্যায়ে লক্ষ করা যায়। এখানে ভগবানের আহ্বান রয়েছে - সতত আমাকে স্মরণ কর, আমাতে মনোনিবেশ কর। আমার ভজনা কর, আমাতেই সমস্ত কর্ম সমর্পণ কর, একমাত্র আমারই শরণ লও ইত্যাদি উক্তির মধ্য দিয়ে ভগবদ্ভক্তির উপদেশ লাভ করা যায়। এই ভক্তির ধারাটি আরো বিকাশ লাভ করে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে শ্ৰীমদ্‌ভাগবত গ্রন্থে ।


আধুনিক ধর্ম সংস্কারের যুগ

ঊনবিংশ শতকে হিন্দুধর্মে তথা বাংলাদেশের হিন্দুধর্মে এক বিশেষ চিন্তাচেতনার বিকাশ লক্ষ করা যায় । বিজ্ঞানমনস্ক সুধীজন সনাতন তথা হিন্দুধর্মের প্রচলিত পূজা-পার্বণ, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন । তাঁরা মনে করেন, যুক্তিসংগত নির্দেশ ছাড়া সামাজিক আচার-আচরণে যে প্রচলিত ধর্মীয় বিধি-বিধান সেগুলো সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে । শাস্ত্রেও বলা হয়েছে 'যুক্তিহীনবিচারেণ ধর্মহানিঃ প্রজায়তে'-যুক্তিহীন বিচারে ধর্মের হানি ঘটে । এক্ষেত্রে যুক্তিবাদী সংস্কারক মনীষীদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায়ের কথা বিশেষভাবে স্মরণীয় । তিনি লক্ষ করেন, বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসক হয়ে এক হিন্দু সম্প্রদায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীচিন্তায় সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। সব উপাস্য যে একই ব্রহ্মের বিভিন্ন প্রকাশ, হিন্দু সম্প্রদায় তা ভুলতে বসেছে । তখন তিনি এক ব্রহ্মের উপাসনার তত্ত্বকে উপস্থাপিত করেন । এভাবে তিনি হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য এক ব্রহ্মকে সাধনার আহ্বান জানালেন। স্থাপন করলেন 'ব্রাহ্মসমাজ' । তিনি বললেন ব্রহ্মই একমাত্র আরাধ্য । হিন্দুরা একেশ্বরবাদী ।

হিন্দুধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

তাঁর এই সংস্কার-চেতনা সুধীমহলে নন্দিত হলেও সাধারণ মানুষ তাদের প্রচলিত বিশ্বাস ও পূজা-পার্বণ ত্যাগ করতে পারেনি । এদের অনুভূতিতে শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সাকার মাতৃসাধনার সাফল্যের দ্বারা। একশ্বেরবাদী ধারণা আর বহু দেব- দেবীরূপে ঈশ্বর আরাধনা এ দুইয়ের সমন্বয় সাধিত হয় ঠাকুর রামকৃষ্ণের অমর উপদেশে যত মত, তত পথ'; 'যত্র জীব, তত্র শিব' ইত্যাদি বাণীর মাধ্যমে ।

ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভাবাদর্শগুলো প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৮৮৬ সালে রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৮৯৭ সালে স্বামী বিবেকানন্দ কর্তৃক রামকৃষ্ণ মিশন স্থাপিত হয় । এই রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন নামে যুগ্ম প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাপী রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলন বা বেদান্ত আন্দোলন সক্রিয়ভাবে পরিচালনা করছে। স্বামী বিবেকানন্দের বাণী 'বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাব গ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শাস্তি' । এই আদর্শটি শুধু হিন্দুধর্মের প্রেক্ষাপটে নয়, এটি বিশ্ব মানবতার ক্ষেত্রেও সমানভাবে ক্রিয়াশীল ।

হরিচাঁদ ঠাকুর ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে আবির্ভূত হয়ে হিন্দু সমাজে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষকে এক হরিনামে মেতে থাকার আহ্বান জানান । তাঁর এই ধর্মনীতি থেকেই মতুয়া ধর্মের উদ্ভব । এ ধর্মের মূলমন্ত্র হচ্ছে ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে হরিনামে মেতে থাকা । হরিনামই জগতে কল্যাণ, শান্তি, সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ ।

এখানে উল্লেখ্য, হিন্দুধর্ম বিকাশের ক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর (পঞ্চদশ শতক) প্রেমভক্তির ধর্ম তথা আন্দোলনটি বিশেষ অবদান রাখতে সমর্থ হয়। চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রেমভক্তির আন্দোলনটি হিন্দুধর্ম চেতনায় বিভিন্ন দেব-দেবীর অনুসারীদের বিদ্বেষ এবং বর্ণভেদ প্রথা দূর করতে অনেকখানি সমর্থ হয়। প্রেমপূর্ণ ভক্তি দিয়েই পরম আরাধ্য ভগবানকে লাভ করা যায়। আর ধর্ম আচরণে ব্রাহ্মণ, অব্রাহ্মণ, নারী, পুরুষ সকলের সমান অধিকার রয়েছে। চৈতন্য মহাপ্রভুর এই প্রেমভক্তি অনুসরণ করে আবির্ভাব ঘটে প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের। তিনি চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রদর্শিত পথের সাধক হয়ে ধর্ম সাধনার ক্ষেত্রে এক অনন্য অবদান রেখে গেছেন । তাঁর এই আদর্শকে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে তাঁর পরম ভক্ত মহেন্দ্ৰজী মহানাম সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন আর এই সম্প্রদায়ের গৌরবোজ্জ্বল নক্ষত্র বৈষ্ণব আচার্য হচ্ছেন ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী। তাঁর সুগভীর পাণ্ডিত্যে এবং একনিষ্ঠ ভক্তিতে কৃষ্ণ-গৌর-বন্ধু লীলা মাধুর্য প্রকাশিত। মহানাম কীর্তন জীবের উদ্ধারের উপকরণ ।

শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত প্রেমভক্তির ধর্মটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচার করার মানসে ১৯৬৬ সালে জুলাই মাসে নিউইয়র্ক শহরে শ্রীল এ.সি. ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ ইসকন' (ISKCON) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বৈষ্ণব ধর্মের পরিপোষক । শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা, শ্রীমদ্ভাগবদ, শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থের ইংরেজি ভার্সন প্রকাশ করেন ।

বৈরাগ্যময় জীবনের অনুসারী প্রভুপাদ সমাজ জীবন থেকে বিভিন্ন প্রকার পাপকর্ম দূর করতে সচেষ্ট হন। তাঁর অনুশীলিত 'হরে কৃষ্ণ' মহামন্ত্র কীর্তন জীবের মুক্তিলাভের অবলম্বন হয়ে জগতে নাম মাহাত্ম্য প্রচার করছে ।

ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ১৮৮৮ সালে পাবনা জেলার হিমাইতপুর গ্রামে আবির্ভূত হন। তিনি 'সৎসঙ্গ' নামে একটি ধর্মীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। সৎসঙ্গের আদর্শ হচ্ছে - ধর্ম কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয় বরং বিজ্ঞানসিদ্ধ জীবনসূত্র । ভালোবাসাই মহামূল্য যা দিয়ে শান্তি কেনা যায় । এ সংঘের পাঁচটি মূলনীতি হচ্ছে- যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি, স্বস্ত্যয়নী ও সদাচার। আর এ সংঘের মূল স্তম্ভ হিসেবে শিক্ষা, কৃষি, শিল্প ও সুবিবাহ নীতিগুলো অনুশীলিত হচ্ছে। এমনিভাবে ধর্ম ও বিজ্ঞানকে একত্রিত করে জীবন গঠনই সৎসঙ্গীদের আদর্শ। তাঁর ছড়া, কবিতা, প্রার্থনা, গীত, সংকীর্তন গান এগুলো বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছে। সৎসঙ্গ চায় আদর্শ মানুষ, আদর্শ গৃহী, আদর্শ ধর্মযাজক। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন ধর্মের ঐক্য প্রতিষ্ঠায় নন্দিত হচ্ছে ।

হিন্দুধর্মের বিকাশের স্তরে স্তরে যে নতুন নতুন ধর্মচর্চার রূপ প্রকাশিত হয়েছে, সেক্ষেত্রে অখণ্ডমণ্ডলীর অবদান স্মরণীয় । এঁদের সংগঠনের নাম 'অযাচক আশ্রম' । এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংস ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের চাঁদপুর শহরে আবির্ভূত হন । অযাচক আশ্রমের নামটির মধ্যেই এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে অর্থ যাচঞা না করা এ সংগঠনের আদর্শ। স্বাবলম্বী হয়ে সমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করাই এ সংগঠনের মুখ্য উদ্দেশ্য । অযাচক আশ্রমের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমবেত উপাসনায় চরিত্র গঠন, সমাজ সংস্কার, ব্রহ্মচর্য, স্বাবলম্বন ও জগতের কল্যাণের কাজে নিযুক্ত থাকা। স্বামী স্বরূপানন্দের আদর্শকে রূপদান করার লক্ষ্যে চরিত্র গঠন আন্দোলন শুরু হয় ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি। এর মূল আবেদন 'আমি ভালো মানুষ হব এবং অপরকে ভালো হতে সহায়তা দিব' । স্বামী স্বরূপানন্দ রচিত বহু গ্রন্থ, সংগীত সমাজের কল্যাণ সাধনে বিশেষ অবদান রাখতে সমর্থ হচ্ছে ।

স্বামী স্বরূপানন্দের জীবনাদর্শ থেকে আমরা এ শিক্ষা পাই যে, সকলকে সমানভাবে ভালোবাসতে হবে । সকলের তরে সকলে আমরা এ ছিল তাঁর কল্যাণময় জীবনভাবনা ।

স্বামী প্রণবানন্দের (১৮৯৬-১৯৪১) সেবাদর্শ হিন্দু সমাজকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করছে। ১৯২১ সালে তিনি দুর্ভিক্ষপীড়িত জনগণের সেবা করেন । তিনি অস্পৃশ্যতাকে দূর করে সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠার কথা বলতেন । জনগণের সেবা করার জন্য তিনি ভারত সেবাশ্রম সংঘ' নামে একটি সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন ।

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী সাধনায় সিদ্ধি লাভ করার পরও লোকসেবা বা লোকশিক্ষার জন্য সাধারণের মধ্যে নেমে এসেছিলেন । তিনি বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার বারদীতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে জনগণের সেবা করতে থাকেন । সততা, নিষ্ঠা, সংযম, সাম্য ও সেবা ছিল তাঁর নৈতিক আদর্শের মূলমন্ত্র। তিনি প্রচলিত অর্থে গুরুগিরি করেননি । কিন্তু পালন করেছেন একজন লোকশিক্ষকের ভূমিকা। তাঁর সান্নিধ্যে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা তাঁকে গুরুই বিবেচনা করতেন। বাংলাদেশ এবং ভারতসহ বিদেশের বিভিন্ন স্থানে লোকনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাবা লোকনাথকে কেন্দ্র করে বারদীর লোকনাথ মন্দিরের পরিচালনা পরিষদ, ঢাকার স্বামীবাগে প্রতিষ্ঠিত লোকনাথ মন্দিরকেন্দ্রিক লোকনাথ সেবক সংঘ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছে । বাংলাদেশে এ রকম আরও ধর্মীয় সংগঠন হিন্দুধর্মের প্রচার ও বিকাশে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে চলেছে ।

হিন্দুধর্মের চিন্তা-চেতনায় বিভিন্ন মত ও পথের সন্ধান মেলে। তবে এই বৈচিত্র্যের মধ্যে এক মহান মিলন সূত্র লক্ষ করা যায়। হিন্দু ধর্ম সংস্কারপন্থী হয়েও সনাতন ভাবধারা সংরক্ষণ করে চলছে । মানব জীবনের ব্যবহারিক সমৃদ্ধিসহ আধ্যাত্মিক জীবনের পরম কল্যাণ লাভ হিন্দু ধর্মের মৌলিক স্তম্ভ। এটি যুগ পরিক্রমার বৈচিত্র্যময় প্রকাশের মধ্য দিয়ে এক অনন্য ভাবেরই দ্যোতনা বহন করছে। হিন্দুধর্মের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য চেতনা উপলব্ধি করে মহান হিন্দুধর্মাবলম্বীগণ গৌরব বোধ করে থাকেন ।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
Post a Comment (0)
To Top