রথযাত্রার মাহাত্ম্য
কঠোপনিষদ বলেছেন, ‘আত্মা হলো রথী, শরীর হলো রথ, বুদ্ধি হলো সারথি, মন হলো লাগাম । মনীষীরা ইন্দ্রিয়গুলোকে দেহরথের অশ্ব বিষয়গুলোকে ইন্দ্রিয়গুলোর বিচরণ ভূমি এবং দেহ-মন ও ইন্দ্রিয়যুক্ত আত্মাকে ভোক্তা বলেছেন । যে পুরুষের সারথি (বুদ্ধি) অসংযত মনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অবিবেকী হয় তার ইন্দ্রিয় সব লৌকিক সারথির দুষ্টু অশ্বের মতো আপন বশে থাকে না । কিন্তু যার বুদ্ধি বিবেকবান, মন সংযত, যার অন্তঃকরণ সর্বদা পবিত্র, তিনি সেই পরম পদপ্রাপ্ত হন । তাকে আবার আর সংসারে জন্মগ্রহণ করতে হয় না । সে পরমপদ প্রাপ্তি অর্থাৎ অভীষ্ট লক্ষ্যের পথ অতি দুর্গম, এ জন্য উপযুক্ত ‘যান’ প্রয়োজন । ‘রথ’ পথযাত্রার একটি প্রকৃষ্ট যান । এ রথের সুযোগ্য চালক বা সারথি প্রয়োজন, তার সঙ্গে প্রয়োজন শক্তিশালী বশীভূত তথা বিশ্বস্ত অশ্ব ও সুদৃঢ় লাগাম । শাস্ত্রকাররা রূপক ছলে বলেছেন, অবিদ্যাবশে সংসারী জীবনের এ দেহটাই ‘রথ’ এবং রথের অধিষ্ঠাতা আত্মীয় ‘রথী’ । সুতরাং, প্রাণ থাকা পর্যন্ত দেহকে অবহেলা করতে নেই । তাই ঋষিরা বলেছেন, আত্মা নং বিদ্ধি আত্মাকে জানো, রথযাত্রায় চরম আধ্যাত্মিক রহস্যকে সূক্ষ্ম রূপে তুলে ধরা হয়েছে ।
মানুষের দেহ হচ্ছে একটি রথ, ঈশ্বর হচ্ছেন তার সারথী, যিনি এই ভবসাগর পরিভ্রমণ পরিচালনা করেন । আত্মা হচ্ছে পরিভ্রমণকারী এবং দেহ তা ধারণ করে জন্ম থেকে জন্মান্তরে বিচরণ করছে । প্রাণশক্তি, পরধর্মসহিষ্ণুতা, আত্মসংযম, দয়া, দাক্ষিণ্য, সমতা, প্রশান্তিকে ধারণ করে যেই দেহধারী সঠিক পথ ধরে পরিক্রমা করতে পারে সেই রথ ঈশ্বরের নির্ধারিত আবাসস্থলে পৌঁছতে পারে এবং তার আর পুনর্জন্ম হয় না, বিষ্ণুলোকে বা নিত্যধামে গমন করেন ।
জীবন হচ্ছে এক যাত্রা, পরমাত্মা সাথে মিলনের পথে পরিভ্রমণ করছে অহর্নিশি । জীবনরথে উপবেশনকারী সকল জীবের প্রতি মুনি ঋষিগণ তাই উপদেশ দিয়েছেন সকল অহঙ্কার ও সম্পদ সমর্পণ করো পরমাত্মার কাছে, তার নিদের্শনাই হচ্ছে তোমার জীবনের পাথেয় । তবেই মহামিলনের মাধুরী আস্বাধন করতে পারবে, জীবন হবে ধন্য । এমন একটি আধ্যাত্মিক ভাবনা লালন করে রথযাত্রা উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ প্রভু জগন্নাথকে রথে আসীন অবস্থায় দর্শন করতে বা রথের রসি ধরতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জনও দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না । তাদের বিশ্বাস রথে আসীন জগন্নাথ প্রভুকে দর্শন বড় প্রাপ্তি । শাস্ত্রে বলা হয়েছে রথারুঢ় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীজগন্নাথকে দর্শন করলে এই জড় জগতের জন্ম মৃত্যুর আবদ্ধতা থেকে তাত্ক্ষণিক মুক্তি লাভ করা সম্ভব । এই জাতীয় বিশ্বাস সনাতন ধর্মাবলম্বীদেরকে রথের মহত্ উত্সব পালন করা এবং রথের উপর ঈশ্বরকে দর্শন লাভে অনুপাণিত করে আসছে । রথযাত্রার এমন উত্সব চলে আসছে ৫ হাজারেরও বেশি সময় ধরে ।
প্রভু জগন্নাথ হচ্ছেন জগতের অধিপতি । তিনিই হচ্ছেন পরমাত্মা পরমব্রহ্ম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরেক রূপ । তিনিই হচ্ছেন পরমপ্রভু যার উদ্দেশ্যে নিবেদিত জীব জগতে সব কিছু । তারই উদ্দেশ্যে সকল আয়োজন এবং সকল নিবেদন ।
রথযাত্রার মোক্ষ বা পূণ্য কি?
আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে অনুষ্ঠিত এই রথযাত্রা কিংবা পুনর্যাত্রা অর্থাৎ উল্টোরথ, রথোপরি ভগবান জগন্নাথ, বলদেব ও সুভদ্রাদেবীকে দর্শন করলে এই জগতে আর পুর্নজন্ম হবে না ।