হোলি কি ?
কেন রং নিয়ে খেলতে মানুষ মেতে উঠে ?
স্কন্দপুরাণ গ্রন্থের ফাল্গুনমাহাত্ম্য গ্রন্থাংশে হোলিকা ও প্রহ্লাদের উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে ।
হোলিকা ছিলেন মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর পত্নী দিতির পুত্র হিরণ্যকশিপুর ভগিনী । ব্রহ্মার বরে হিরণ্যকশিপু দেব ও মানব বিজয়ী হয়ে দেবতাদের অবজ্ঞা করতে শুরু করেন । কিন্তু তাঁর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত ।
প্রহ্লাদ বিষ্ণুকে নিজ পিতার উপরে স্থান দেওয়ায় ক্রুদ্ধ হয়ে হিরণ্যকশিপু নিজের পুত্রকে পুড়িয়ে মারার আদেশ দেন । দাদার আজ্ঞায় হোলিকা প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে অগ্নিতে প্রবেশ করেন ।
কারণ হোলিকা এই বর পেয়েছিল যে আগুনে তার কোন ক্ষতি হবে না । কিন্তু অন্যায় কাজে শক্তি প্রয়োগ করায় হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করলে বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ অগ্নিকুণ্ড থেকেও অক্ষত থেকে যায় আর ক্ষমতার অপব্যবহারে হোলিকার বর নষ্ট হয়ে যায় এবং হোলিকা পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়,এই থেকেই হোলি কথাটির উৎপত্তি ।
অন্যদিক বসন্তের পূর্ণিমার এই দিনে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামক অসুরকে বধ করেন। অন্যায়কারী,অত্যাচারী এই অসুরকে বধ করার পর সকলে আনন্দ করে ।
এই অন্যায় শক্তিকে ধ্বংসে মহাআনন্দে পরিণত হয় । বাংলায় আমরা বলি "দোলযাত্রা" আর পশ্চিম ও মধ্যভারতে "হোলি" । রঙ উৎসবের আগের দিন ‘হোলিকা দহন’ হয় অত্যন্ত ধুমধাম করে । শুকনো গাছের ডাল, কাঠ ইত্যাদি দাহ্যবস্তু অনেক আগে থেকে সংগ্রহ করে সু-উচ্চ একতা থাম বানিয়ে তাতে অগ্নি সংযোগ করে‘হোলিকা দহন’ হয় ।
পরের দিন রঙ খেলা । বাংলাতেও দোলের আগের দিন এই রকম হয় যদিও তার ব্যাপকতা কম–আমরা বলি ‘চাঁচর’ । এই চাঁচরেরও অন্যরকম ব্যাখ্যা আছে। দোল আমাদের ঋতুচক্রের শেষ উৎসব । পাতাঝরার সময়,বৈশাখের প্রতীক্ষা । এই সময় পড়ে থাকা গাছের শুকনো পাতা,তার ডালপালা একত্রিত করে জ্বালিয়ে দেওয়ার মধ্যে এক সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে ।
পুরনো জঞ্জাল, রুক্ষতা,শুষ্কতা সরিয়ে নতুনের আহ্বান হচ্ছে এই হোলি ।
বাংলায় দোলের আগের দিন ‘চাঁচর’ উদযাপনকে এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয় ।
আমাদের অনেক ধর্মীয় উৎসবেই আঞ্চলিক লোক-সংস্কৃতি ও রীতির প্রভাব দেখা যায়,হোলিও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলার দোলযাত্রায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব রীতির প্রাধান্য পায়। ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন পূর্বভারতে আর্যরা এই উৎসব পালন করতেন ।
যুগে যুগে এর উদযাপন রীতি পরিবর্তিত হয়ে এসেছে । পুরাকালে বিবাহিত নারী তার পরিবারের মঙ্গল কামনায় রাকা পূর্ণিমায় রঙের উৎসব করতেন ।
দোল হিন্দু সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন উৎসব । নারদ পুরাণ,ভবিষ্যৎ পুরাণ ও ‘জৈমিনি মীমাংশা’য় রঙ উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায় ।
বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সহিত রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। দোল যাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আবির ও গুলালে স্নান করে দোলায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রায় বের করা হয় ।
এরপর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পর রং খেলেন। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয় ।
আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয় । দোলযাত্রা উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিকও রয়েছে ।