কর্ম অনুযায়ী সনাতনী সমাজ চার ভাগে বিভক্ত- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র- এটা আমরা সবাই জানি। কর্মগুনেই ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়রা সমাজে ভালো অবস্থানে থাকে। সমাজে ব্রাহ্মণ তারাই, যারা বিদ্যা-বুদ্ধি খাটিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে, আর ক্ষত্রিয় তারাই, যারা দেশরক্ষা এবং দেশ শাসন করে। এদের বাইরে বৈশ্যরা হলো স্বাধীন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তি, যাদের মাথার উপর কোনো বস নেই; আর শুদ্ররা হলো চাকর শ্রেণী, যাদের মাথার উপর সব সময় বস থাকে, যাদেরকে অন্যের নির্দেশে কাজ করতে হয়, স্বাধীনভাবে যাদের কাজ করার কোনো ক্ষমতা নেই।
বৈশ্য শ্রেণীর লোকজন সাধারণত ব্যবসায়ী হয়, সেটা ক্ষুদ্র ব্যবসা হোক বা বৃহৎ। কামার, কুমার, জেলে, নাপিত, ধোপা- এরাই বৈশ্য শ্রেণীর নিম্নস্তরের মানুষ, যাদেরকে সাধারণ মানুষ শুদ্র ব'লে বিবেচনা করে ভুল করে থাকে।
সমাজে মানুষের মর্যাদা নির্ণিত হয় অর্থের ভিত্তিতে। তো সমাজে যারা নিম্ন আয়ভূক্ত মানুষ, তাদেরকে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে অর্থ সহায়তা করার ব্যবস্থা সনাতন ধর্মে রয়েছে, যেহেতু সনাতন ধর্মে ভিক্ষা করা বা গরীব থাকা পাপ। তাই সনাতনী হিন্দু সমাজে কোনোরকম পারিশ্রমিক বিনিময় ছাড়া কাউকে কিছু দেওয়া নিষেধ বা কারো কাছ থেকে কিছু নেওয়াও নিষেধ।
সনাতনী হিন্দু সমাজে- বিয়ে, জন্ম এবং মৃত্যুর সময় বাধ্যতামূলক নাপিত লাগার কারণ হলো এটাই। নাপিতরা যেহেতু সমাজের নিম্নআয়ভূক্ত মানুষ, সেহেতু নাপিতদেরকে সামান্য কাজ করিয়ে নিয়ে এত বেশি পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয়, যা তার কাজের পারিশ্রমিকের তুলনায় বহুগুন বেশি, নিম্নআয়ভূক্ত মানুষদের জন্য এটা একপ্রকার সামাজিক সহায়তা।
ইসলামে নিম্নআয়ভূক্ত মানুষদের জন্য যাকাত ফিতরার ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে গরীব লোকজন বিনা পরিশ্রমে ধনীদের কাছ থেকে বছরে একবার করে অর্থ সহায়তা পেয়ে থাকে। কিন্তু কাউকে বিনা পরিশ্রমে অর্থ সহায়তা করে তার আর্থিক অবস্থার উন্নতি করা যায় না। বিনা পরিশ্রমে অর্থ সহায়তা পেলে মানুষ কর্মবিমুখ হয় এবং তাতে মানুষ আরো গরীব হয়।
খেয়াল করে দেখবেন, গ্রামের দরিদ্র লোকজন, যারা সাধারণত প্রতিদিন শ্রম বিক্রি করে অর্থ আয় করে, তারা যখন মাঝে মাঝে সরকার থেকে রিলিফ পায়, তখন সেই পাঁচ/সাত কেজি রিলিফের চাল নেওয়ার জন্য সেদিন আর কাজ করে না, যে চালের দাম খুব বেশি হলে দেড়শ বা দুইশ টাকা, কিন্তু সে যদি কাজ করতো, তাহলে সে ঐ দিন ৩০০ বা চারশ টাকা আয় করতে পারতো। এভাবেই বিনা পরিশ্রমে পাওয়া অর্থ মানুষকে গরীব থেকে আরো গরীব করে, এতে সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
ইসলামে বলা আছে- গরীবরা, ধনীদের চেয়ে ৫০০ বছর আগে বেহেশতে যাবে, আবার কুরবানীর মাংসের তিন ভাগের একভাগ সব সময় গরীবদের মাঝে বন্টন করতে হবে এবং যাকাত ফিতরার অর্থও গরীবদের জন্য বরাদ্দ, এই বিষয়গুলো নির্দেশ করে যে ইসলামে একতৃতীয়াংশ মানুষ সব সময় গরীব থাকবে; কারণ, একতৃতীয়াংশ লোক যদি গরীব না থাকে তাহলে যাকাত ফিতরা এবং কুরবানীর একতৃতীয়াংশ মাংসের হবে টা কী ?
কিন্তু সনাতন বা হিন্দু ধর্ম গরীবদের ধর্ম নয়। কোনো লোক যাতে গরীব না থাকে, সেজন্য সনাতন ধর্মে ধন সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর পূজা করার বিধান রয়েছে। অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে লক্ষ্মীর পূজা করলেই যে কেউ প্রচুর ধনী হয়ে যাবে, এমনটা নয়; তবে লক্ষ্মী পূজার কিছু শিক্ষা আছে, সেগুলো যদি কেউ জানে এবং সেগুলো যদি মেনে চলে, তাহলে যে সে ধনী হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই; শুধু তাই নয়, ধন-সম্পদজনিত মানুষের যে বিপদ আপদ ঘটে, সেগুলো থেকেও সে রক্ষা পাবে। লক্ষ্মীপূজার প্রকৃত শিক্ষা একজন মানুষকে ধনী করে তুলবেই, যদি কোনো ব্যক্তি লক্ষ্মীপূজার শিক্ষা না জানে বা না বোঝে, তারপরও যদি সে শুধু ধন সম্পদ অর্জনের জন্য অন্ধবিশ্বাস নিয়ে লক্ষ্মীপূজা করে, এতেও সে কিছু ফল পাবেই; কারণ- ধন সম্পদ অর্জনের যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সে লক্ষ্মীপূজা করেছে, এই আকাঙ্ক্ষাই তাকে কিছুটা হলেও ধনী করবে। কিন্তু যে ব্যক্তি লক্ষ্মীপূজার প্রকৃত শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে জানে বা বোঝে, সে ধনী হবেই, সে গরীব থাকতে পারে না।
সনাতনী সমাজের একেবারে নিম্নআয়ভুক্ত মানুষও যাতে একেবারে হতদরিদ্র না থাকে, তারা যেন সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর মানুষদের থেকে তার কর্মের বিনিময়ে অর্থ পায়, সেই চিন্তা-ভাবনা থেকেই নাপিতদেরকে হিন্দু সমাজের জন্ম, মৃত্যু এবং বিয়ের আচারের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে, যাতে এইসব উপলক্ষ্যে তারা তাদের সামান্য কর্মের বিনিময়ে প্রচুর অর্থ পায় এবং কিছুটা ভালো জীবন যাপন করতে পারে, যেহেতু সনাতন ধর্মে বিনা পরিশ্রমে কারো কাছ থেকে কিছু নেওয়া বা ভিক্ষা করা পাপ বলে বিবেচিত।
এই ভাবে কর্মের বিনিময়ে অর্থে ব্যবস্থা শুধু নাপিতদের ক্ষেত্রেই নেই, পূজায় যারা ঢাক বাজায়, মূর্তি তৈরি করে বা পূজার বিভিন্ন উপকরণ তৈরি বা বিক্রি করে তাদের ক্ষেত্রেও রয়েছে, যেগুলোর ব্যাপক প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই দুর্গাপূজার সময়।
সনাতন ধর্মে যেহেতু বিনা পরিশ্রমে কাউকে কিছু দেওয়া বা কারো কাছ থেকে কিছু নেওয়া নিষেধ, যে কথা আগেই বলেছি- সেহেতু সমাজের নিম্নআয়ভূক্ত মানুষদেরকে সামান্য কর্মের বিনিময়ে বেশি অর্থ প্রদান করে তাদের জীবনযাত্রার মানের কিছুটা উন্নয়ন ঘটনানোর জন্য সনাতনী হিন্দু সমাজের নিম্নআয়ভূক্ত মানুষদেরকে সনাতনী হিন্দু সমাজের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাথে যে যুক্ত করা হয়েছে।