জগদ্ধাত্রী পূজার ইতিবৃত্ত

0

জগদ্ধাত্রী পূজার ইতিবৃত্ত

Table Of Content (toc)

জগদ্ধাত্রী পূজা নিয়ে বিস্তারিত

জগদ্ধাত্রী শব্দের অর্থ

জগদ্ধাত্রী দুর্গা- ‘জয় সর্বগত দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোহস্তুতে’ ! জগদ্ধাত্রী শব্দের আভিধানিক অর্থ “জগৎ+ধাত্রী । জগতের (ত্রিভুবনের) ধাত্রী (ধারণকর্ত্রী, পালিকা) ।” ব্যাপ্ত অর্থে দুর্গা, কালী সহ অন্যান্য শক্তিদেবীগণও জগদ্ধাত্রী । জগদ্ধাত্রী পূজা হিন্দুদের অন্যতম ধর্মীয় অনুষ্ঠান । তিনিই জগৎ সভ্যতার পালিকা শক্তি । তিনি দেবী দুর্গারই আর এক রূপ । তাই জগদ্ধাত্রীর প্রণামমন্ত্রে তাঁকে ‘দুর্গা’ বলে স্তুতি করা হয়েছে । তবে শাস্ত্রনির্দিষ্ট জগদ্ধাত্রী রূপের নামকরণের পশ্চাতে রয়েছে সূক্ষ্মতর ধর্মীয় দর্শন ।

জগদ্ধাত্রী বা জগদ্ধাত্রী দুর্গা হচ্ছেন দেবী দুর্গার রূপভেদ । একই দেবীর দুই রূপ । এক জন দুর্গা, অন্য জন জগদ্ধাত্রী । উপনিষদে এঁর নাম উমা হৈমবতী । বিভিন্ন তন্ত্র ও পুরাণ গ্রন্থেও এঁর উল্লেখ পাওয়া যায় । জগদ্ধাত্রী আরাধনা বিশেষত বঙ্গদেশে প্রচলিত । আবার পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চন্দননগর,গুপ্তিপাড়া ও নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী উৎসব জগদ্বিখ্যাত । কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয় । হিন্দু বাঙালির ধর্মীয় মানসে রাজসিক দেবী দুর্গা ও তামসিক কালীর পরেই স্থান সত্ত্বগুণের দেবী জগদ্ধাত্রীর ।

স্বামী প্রমেয়ানন্দের মতে, “ধৃতিরূপিণী মহাশক্তি জগদ্ধাত্রী । সগুণ ব্রহ্মের সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশরূপ তিনগুণের যুগপৎ প্রকাশ যেমন কালীরূপের বৈশিষ্ট্য, তাঁর ধারণী ও পোষণী গুণের যুগপৎ প্রকাশও জগদ্ধাত্রীরূপের বৈশিষ্ট্য । ধা ধাতুর অর্থ ধারণ বা পোষণ । ভগবতী নিখিল বিশ্বকে বক্ষে ধারণ করে পরিপালন করেন বলে মুনিগণ কর্তৃক তিনি ত্রৈলোক্যজননী নামে অভিহিত । নিয়ত-পরিবর্তনশীল এই জগতের পেছনে রয়েছে তার রক্ষণ ও পোষণের জন্য অচিন্তনীয়া মহাশক্তির এক অদ্ভুত খেলা । সতত পরিবর্তনশীল জগৎ সেই মহাশক্তির দ্বারা বিধৃত – যিনি নিত্যা, শাশ্বতী ও অপরিবর্তনীয়া । দেবী জগদ্ধাত্রীই সেই ধৃতিরূপিণী মহাশক্তি।”

তিনি সিংহবাহিনী, তবে দুর্গার মতো জগদ্ধাত্রী দশভূজা নন চতুর্ভুজা, নানা আভরণভূষিতা, অরুণকিরণবৎ বর্ণযুক্তা এবং সর্পরূপ যজ্ঞোপবীতধারিণী । তাঁর বাম দিকের দুহাতে থাকে শঙ্খ ও ধনু এবং ডান দিকের দুহাতে থাকে চক্র ও পঞ্চবাণ । রক্তবর্ণের বস্ত্র তাঁর পরিধানে । তিনি সত্ত্বগুণের প্রতীক, তাই প্রথম সূর্যের মতো তাঁর গায়ের রং । অর্থাৎ, দেবীর গাত্রবর্ণটি কমলা । কিন্তু, দুর্গার সঙ্গে তাঁর সংযোগ স্থাপন করে বর্তমানে তাঁর মূর্তিটি নির্মাণ করা হয় তা হল তপ্তকাঞ্চনবর্ণ বা কাঁচা সোনার রঙে । কমলা রঙের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা বর্তমানে এই বঙ্গে দুর্লভ । বাহন সিংহ করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ হস্তীরূপী অসুরের পৃষ্ঠে দণ্ডায়মান । কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয় । হিন্দু বাঙালির ধর্মীয় মানসে রাজসিক দেবী দুর্গা ও তামসিক কালীর পরেই স্থান সত্ত্বগুণের দেবী জগদ্ধাত্রীর । নারদাদি মুনিগণ তাঁর নিত্যসেবা করে থাকেন-

সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম

চতুর্ভূজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্

শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্তবামপাণিদ্বয়ান্বিতাম্

চক্রঞ্চ পঞ্চবাণাংশ্চ দধতীং দক্ষিণে করে

রক্তবস্ত্রাপরিধানাং বালার্কসদৃশীতনুম্

নারদাদ্যৈর্মুনিগণৈঃ সেবিতাং ভবসুন্দরীম্।

জগদ্ধাত্রী পূজার নিয়মটি একটু স্বতন্ত্র । দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপূজার ঠিক একমাস পর কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে । কাত্যায়নীতন্ত্র–এ কার্তিকী শুক্লা নবমীতে দেবী জগদ্ধাত্রীর আবির্ভূত হওয়ার কথা আছে । জগদ্ধাত্রী পূজা তান্ত্রিক পূজা । দুটি প্রথায় এই পূজা হয়ে থাকে । সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী – এই তিন দিন জগদ্ধাত্রীর পূজা হয়ে থাকে ।  কোথাও কোথাও প্রথম বা দ্বিতীয় পূজার পর কুমারী পূজারও আয়োজন করা হয় । দুর্গাপূজার ন্যায় জগদ্ধাত্রী পূজাতেও বিসর্জনকৃত্য বিজয়াকৃত্য নামে পরিচিত । এমনকি পুষ্পাঞ্জলি ও প্রণাম মন্ত্রসহ পূজার অনেক মন্ত্রও দুর্গাপূজার অনুরূপ ।

জগদ্ধাত্রী স্তোত্র

ওঁ আধারভূতে চাধেয়ে ধৃতিরূপে ধুরন্ধরে।
ধ্রূবে ধ্রূবপদে ধীরে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
শবাকারে শক্তিরূপে শক্তিস্থে শক্তিবিগ্রহে।
শাক্তাচার প্রিয়ে দেবি জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
জয়দে জগদানন্দে জগদেক প্রপূজিতে।
জয় সর্ব্বগতে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
পরমাণু স্বরূপে চ দ্ব্যণুকাদি স্বরূপিণি।
স্থূলাতি সূক্ষ্ম রূপেণ জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম রূপে চ প্রাণাপানাদিরূপিণি।
ভাবাভাব স্বরূপে চ জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
কালাদি রূপে কালেশে কালাকাল বিভেদিনি।
সর্ব্ব স্বরূপে সর্ব্বজ্ঞে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
মহাবিঘ্নে মহোৎসাহে মহামায়ে বলপ্রদে।
প্রপঞ্চাসারে সাধ্বীশে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
অগম্যে জগতামাদ্যে মাহেশ্বরি বরাঙ্গনে।
অশেষ রূপে রূপস্থে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
দ্বিসপ্তকোটি মন্ত্রাণাং শক্তিরূপে সনাতনি।
সর্ব্ব শক্তি স্বরূপে চ জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
তীর্থযজ্ঞ তপোদান যোগসারে জগন্ময়ি।
ত্বমেব সর্ব্বং সর্ব্বস্থে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
দয়ারূপে দয়াদৃষ্টে দয়াদ্রে দুঃখমোচনি।
সর্ব্বাপত্তারিকে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
অগম্য ধামাধামস্থে মহাযোগীশ হৃৎপুরে।
অমেয় ভাব কূটস্থে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
যঃ পঠেৎ স্তোত্রমেতত্তু পূজান্তে সাধক উত্তমঃ।
সর্ব্ব পাপৎ বিনির্মুক্তঃ পূজা ফলং অবামুয়াৎ॥
ইতি শ্রীজগদ্ধাত্রীকল্পে জগদ্ধাত্রী স্তোত্রং সমাপ্তম্॥

জগদ্ধাত্রী পূজার ইতিহাস

জগদ্ধাত্রীর প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় মায়াতন্ত্রে, বৃহস্পতি রায়মুকুটের স্মৃতিরত্নহারে (১৫-১৬শ শতক), কৃষ্ণানন্দের তন্ত্রসারে (১৬শ শতক) এবং শ্রীনাথ আচার্যচূড়ামণির কৃত্যতত্ত্বার্ণবে । আবার কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর হুতোম প্যাঁচার নকশায় লিখছেন, সেই সময়ের বাবু কলকাতা দুর্গার মতো জগদ্ধাত্রী মূর্তিতেও স্থান দিয়েছে লক্ষ্মী-সরস্বতীকে- “বারোইয়ারি প্রতিমাখানি প্রায় বিশ হাত উঁচু– ঘোড়ায় চড়া হাইল্যান্ডের গোরা, বিবি, পরী ও নানাবিধ চিড়িয়া, শোলার ফল ও পদ্ম দিয়ে সাজানো; মধ্যে মা ভগবতী জগদ্ধাত্রী-মূর্তি– সিঙ্গির গায়ে রূপুলি গিলটি ও হাতী সবুজ মখমল দিয়ে মোড়া । ঠাকরুণের বিবিয়ানা মুখ, রং ও গড়ন আদল ইহুদী ও আরমানী কেতা, ব্রহ্মা বিষ্ণু, মহেশ্বর ও ইন্দ্র দাঁড়িয়ে জোড়হাত ক’রে স্তব কচ্চেন ।”

জগদ্ধাত্রী পূজা বাঙালি হিন্দু সমাজের একটি বিশিষ্ট উৎসব হলেও, দুর্গা বা কালীপূজার তুলনায় এই পূজার প্রচলন অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে ঘটে । অষ্টাদশ শতকে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগরে এই পূজার প্রচলন করার পর এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় । যদিও দেবী জগদ্ধাত্রী যে বাঙালি সমাজে একান্ত অপরিচিত ছিলেন না, তার প্রমাণও পাওয়া যায় । শূলপাণি খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে কালবিবেক গ্রন্থে কার্তিক মাসে জগদ্ধাত্রী পূজার উল্লেখ করেন । পূর্ববঙ্গের বরিশালে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত জগদ্ধাত্রীর একটি প্রস্তরমূর্তি পাওয়া যায় । বর্তমানে এই মূর্তিটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার প্রত্নবিভাগে রক্ষিত । কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের আগে নির্মিত নদিয়ার শান্তিপুরের জলেশ্বর শিবমন্দির ও কোতোয়ালি থানার রাঘবেশ্বর শিবমন্দিরের ভাস্কর্যে জগদ্ধাত্রীর মূর্তি লক্ষিত হয় ।

তবে বাংলার জনসমাজে কৃষ্ণচন্দ্রে পূর্বে জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি । কেবল কিছু ব্রাহ্মণগৃহে দুর্গাপূজার পাশাপাশি জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হত । জগদ্ধাত্রী পূজা প্রথমে কট্টর ভাবেই প্রচলিত ছিল ব্রাহ্মণদের মধ্যে । দেবী সত্ত্বগুণের প্রতীক যা ব্রাহ্মণদের একটি বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য করা হয় । দেবীর গলায় থাকে নাগযজ্ঞোপবীত যা স্পষ্টভাবেই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের পরিচায়ক । আবার, মন্ত্রে এই দেবীকে সাক্ষাৎ ব্রাহ্মণ বলেও অভিহিত করা হয়েছে । এখান থেকেই তৈরি হয়েছে বিকল্প এবং শ্রেণিবিভাগ । সত্ত্বগুণধারিণী জগদ্ধাত্রীর পূজা করবেন ব্রাহ্ণরা, রজোগুণধারিণী দুর্গার পূজা ক্ষত্রিয়রা এবং তমোগুণধারিণী কালীর পূজা অন্যরা । পরে ব্রাহ্মণদের এই জগদ্ধাত্রী আরাধনার সূত্রটি গ্রহণ করলেন বণিকশ্রেণি । দুর্গাপূজায় তাঁদের অধিকার নেই, কালীপূজা তন্ত্রসম্মত বলে সবার সামর্থ্য নয়, অতএব রইলেন কেবল এই জগদ্ধাত্রী দুর্গাই !

উপনিষদে দেবী জগদ্ধাত্রী

কেন উপনিষদে উল্লিখিত একটি উপাখ্যান অনুসারেঃ জগদ্ধাত্রীস্তোত্রের তিন নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে- 

জয়দে জগদানন্দে জগদেক প্রপূজিতে

জয় সর্ব্বগতে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে ।

আবার কিছু কিছু পুরাণ বলছে, মহিষাসুর বধের পর দেবতাদের উল্লাসের কথা । তাঁরা ভেবেছিলেন, দুর্গা যেহেতু তাঁদেরই সম্মিলিত শক্তির প্রকাশ, তাই অসুর বধ হয়েছে তাঁদেরই যুগ্ম শক্তিতে । ব্রহ্মার বরের সম্মানরক্ষা করতে কেবল ওই নারীদেহটির আবশ্যিকতা । তখন ব্রহ্ম যক্ষের বেশ ধারণ করে তাদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন । তাঁদের ওই গর্ব দেখে পরমেশ্বরী দেবী একটি তৃণখণ্ড অলক্ষ থেকে নিক্ষেপ করলেন দেবতাদের দিকে । পরীক্ষা করতে চাইলেন তাঁদের শক্তি । ইন্দ্র বজ্রদ্বারা সেই তৃণটি ধ্বংস করতে ব্যর্থ হলেন । অগ্নি সেই তৃণ দহন করতে পারলেন না, বায়ু অসমর্থ হলেন তা উড়িয়ে নিয়ে যেতে । বরুণের শক্তি সেই তৃণটুকুর একটি অংশও জলস্রোতে প্লাবিত করতে পারল না । দেবতাদের এই দুরবস্থা দেখে তাঁদের সামনে আবির্ভূতা হল এক পরমাসুন্দরী সালঙ্কারা চতুর্ভুজা মূর্তি । তিনিই জগদ্ধাত্রী । জগদ্ধাত্রী এভাবে আবির্ভূতা হয়ে দেবতাদের জ্ঞানচক্ষুটি উন্মীলিত করলেন । বুঝিয়ে দিলেন, তিনিই এই জগতের ধারিণী শক্তি ।

কাত্যায়নী তন্ত্র

উপনিষদে উমার রূপবর্ণনা নেই । কেবলমাত্র তাকে হৈমবতী অর্থাৎ স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা বলা হয়েছে । তবে এই হৈমবতী উমাই যে দেবী জগদ্ধাত্রী সে প্রত্যয় জন্মে কাত্যায়ণী তন্ত্রের ৭৬ পটলে (অধ্যায়) উল্লিখিত একটি কাহিনি থেকে । এই কাহিনি অনুসারে : একদা ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু ও চন্দ্র – এই চার দেবতা অহংকার-প্রমত্ত হয়ে নিজেদের ঈশ্বর মনে করতে শুরু করলেন । তারা বিস্মৃত হলেন যে দেবতা হলেও তাদের স্বতন্ত্র কোনও শক্তি নেই – মহাশক্তির শক্তিতেই তারা বলীয়ান। দেবগণের এই ভ্রান্তি অপনয়নের জন্য দেবী জগদ্ধাত্রী কোটি সূর্যের তেজ ও কোটি চন্দ্রের প্রভাযুক্ত এক দিব্য মূর্তিতে তাদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন । এর পরের কাহিনি কেন উপনিষদে বর্ণিত তৃণখণ্ডের কাহিনির অনুরূপ । দেবী প্রত্যেকের সম্মুখে একটি করে তৃণখণ্ড রাখলেন; কিন্তু চার দেবতার কেউই তাকে স্থানচ্যুত বা ভষ্মীভূত করতে অসমর্থ হলেন । দেবগণ নিজেদের ভুল উপলব্ধি করলেন। তখন দেবী তার তেজোরাশি স্তিমিত করে এই অনিন্দ্য মূর্তি ধারণ করলেন । এই মূর্তি ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা, রক্তাম্বরা, সালংকারা, নাগযজ্ঞোপবীতধারিনী ও দেব-ঋষিগণ কর্তৃক অভিবন্দিতা এক মঙ্গলময়ী মহাদেবীর মূর্তি । সমগ্র জগৎকে পরিব্যাপ্ত করে দেবী দেবগণকে এই মূর্তি দেখালেন । দেবগণও তার স্তবে প্রবুদ্ধ হলেন ।

মূর্তিত্বত্ত

জগদ্ধাত্রীর ধ্যানমন্ত্রে দেবীর যে রূপকল্পনা করা হয়েছে তা নিম্নরূপঃ

সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম্।
চতুর্ভূজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্।।
শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্তবামপাণিদ্বয়ান্বিতাম্।
চক্রঞ্চ পঞ্চবাণাংশ্চ দধতীং দক্ষিণে করে।।
রক্তবস্ত্রাপরিধানাং বালার্কসদৃশীতনুম্।
নারদাদ্যৈর্মুনিগণৈঃ সেবিতাং ভবসুন্দরীম্।।
ত্রিবলীবলয়োপেতনাভিনালমৃণালিনীম্।
রত্নদ্বীপে মহাদ্বীপে সিংহাসনসমন্বিতে।
প্রফুল্লকমলারূঢ়াং ধ্যায়েত্তাং ভবগেহিনীম্।।

সরলার্থঃ মহাদেবী জগদ্ধাত্রী সিংহের স্কন্ধে আরূঢ়া, নানা অলংকারে ভূষিতা ও নাগরূপ যজ্ঞোপবীতধারিণী । দেবীর বাম হস্তদ্বয়ে শঙ্খ ও শার্ঙ্গধনু; দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে চক্র ও পঞ্চবাণ । রক্তবস্ত্রপরিহিতা সেই ভবসুন্দরী প্রভাতসূর্যের ন্যায় রক্তবর্ণা । নারদাদি মুনিগণ তার নিত্যসেবা করে থাকেন । তার ত্রিবলিবলয়সমন্বিত নাভিমণ্ডল মৃণালবিশিষ্ট পদ্মের ন্যায় । সেই শিবপত্নী রত্নদ্বীপরূপ উচ্চ বেদিকায় স্থিত সিংহাসনে প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর উপবিষ্টা । নাগযজ্ঞোপবীতিনী জগদ্ধাত্রী; নাগরূপ যজ্ঞোপবীত মহাযোগিনী ব্রহ্মময়ী জগদ্ধাত্রীর প্রতীক ।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
Post a Comment (0)
To Top