Table Of Content (toc)
কুমারী পূজা কি ?
দুর্গোৎসবের একটি বড় অঙ্গ হচ্ছে কুমারী পূজা । কুমারী পূজা নিয়ে আমাদের মধ্যে যেন কৌতূহলের কমতি নেই । ভারত ও বাংলাদেশের রামকৃষ্ণ মিশনসহ বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী মন্দিরে অষ্টমীর মহাতিথিতে এই কুমারী পূজা হয়ে থাকে । শাস্ত্রকাররা নারীকে সন্মান ও শ্রদ্ধা করতে এই পূজা করতে বলেছেন । আমাদের হিন্দুধর্মে নারীকে সন্মানের শ্রেষ্ঠ আসনে বসানো হয়েছে ।
মূলকথা নিজেদের পশুত্বকে সংযত রেখে নারীকে সন্মান জানাতে হবে - এটাই কুমারী পূজার মূল লক্ষ্য ।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ- এ রামের জন্য ব্রহ্মার দুর্গাপূজার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় । তখন শরৎকাল, দক্ষিণায়ণ । দেবতাদের নিদ্রার সময় । তাই, ব্রহ্মা স্তব করে দেবীকে জাগরিত করলেন । দেবী তখন কুমারীর বেশে এসে ব্রহ্মাকে বললেন, বিল্ববৃক্ষমূলে দুর্গার বোধন করতে ।
দেবতারা মর্ত্যে এসে দেখলেন, এক দুর্গম স্থানে একটি বেলগাছের শাখায় সবুজ পাতার রাশির মধ্যে ঘুমিয়ে রয়েছে একটি তপ্তকাঞ্চন বর্ণা বালিকা । ব্রহ্মা বুঝলেন,এই বালিকাই জগজ্জননী দুর্গা । তিনি বোধন- স্তবে তাঁকে জাগরিত করলেন ।
এখানেঃ দুর্গা পূজা পদ্ধতি pdf ডাউনলোড করুন
ব্রহ্মার স্তবে জাগরিতা দেবী বালিকামূর্তি ত্যাগ করে চণ্ডিকামূর্তি ধারন করলেন । তন্ত্রসার মতে, “১ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত বালিকারা কুমারী পূজার উপযুক্ত । তাদের অবশ্যই ঋতুমতি হওয়া চলবে না । মেরুতন্ত্রে বলা হয়েছে, সর্বকামনা সিদ্ধির জন্য ব্রাহ্মণ কন্যা, যশোলাভের জন্য ক্ষত্রিয় কন্যা, ধনলাভের জন্য বৈশ্য কন্যা ও পুত্র লাভের জন্য শূদ্রকূল জাত কন্যা কুমারী পূজার জন্য যোগ্য । গুণ ও কর্ম অনুসারেই এই জাতি বা বর্ণ নির্ধারিত হয় । সেইজন্যই প্রচলিত শাস্ত্র অনুসারে, বিভিন্ন মিশন ও মন্দিরগুলোতে সর্ব মঙ্গলের জন্য ব্রাহ্মণ কন্যাকেই দেবী জ্ঞানে পূজা করা হয় ।
সকল নারীর মধ্যই বিরাজিত রয়েছে দেবীশক্তি । তবে কুমারী রূপেই মা দুর্গা বিশেষভাবে প্রকটিত হয়েছিলেন । তাই, কুমারী রূপে নারীকে দেবীজ্ঞানে সন্মান জানানোর একটি বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে কুমারী পূজা ।
কুমারী পূজা মাতৃরূপে ইশ্বরেরই একটি আরাধনা । মনু সংহিতায় আছেঃ
‘যত্র নার্যন্তু পূজ্যতে রমন্তে তত্র দেবতাঃ
যত্রৈতান্তু ন পূজ্যতে সর্বান্তুত্রাফলাঃ ক্রিয়া’।
এর অর্থ হল, যেখানে নারীরা পূজিত হন সেখানে দেবতারা প্রসন্ন হন । যেখানে নারীরা সম্মান পান না, সেখানে সব কাজই নিষ্ফল ।
আবার মহাদেব যোগিনী শাস্ত্রে বলেছেনঃ
‘কুমারী পূজনং ফলং বক্তু নার্হামি সুন্দরী।
জিহ্বাকোটি সহস্রৈস্তু বক্ত্রকোটি শতৈরপি’।
এর অর্থ, শতকোটি জিহ্বায় কুমারী পূজার ফল ব্যক্ত করতে পারব না ।
কুমারী পূজা কেন করা হয় ?
আজ মহাষ্টমী । শারদীয় দুর্গা পূজার সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং জাঁকজমকপূর্ণ দিন এটি । দেবীর সন্ধিপূজা এবং কুমারী পূজার মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা । কুমারী বালিকার মধ্যে শুদ্ধ নারীর রূপ চিন্তা করে তাকে দেবী জ্ঞানে পূজার নামই কুমারী পূজা ।
হিন্দু শাস্ত্র মতে, সাধারণত এক বছর থেকে ১৬ বছরের অজাতপুষ্প সুলক্ষণা কুমারীকে পূজার উল্লেখ রয়েছে । ব্রাহ্মণ অবিবাহিত কন্যা অথবা অন্য গোত্রের অবিবাহিত কন্যাকেও পূজা করার বিধান রয়েছে । বয়সভেদে কুমারীর নাম হয় ভিন্ন ।
- সপ্তম বর্ষীয়া কুমারীর নাম মালিনী ।
- অষ্টম বর্ষীয়া কুমারীর নাম কুব্জিকা ।
- নবম বর্ষীয়া কুমারীর নাম কালসন্দর্ভা ।
- দশম বর্ষীয়া কুমারীর নাম অপরাজিতা ।
- একাদশ বর্ষীয়া কুমারীর নাম রুদ্রানী ।
- দ্বাদশ বর্ষীয়া কুমারীর নাম ভৈরবী ।
- ত্রয়োদশ বর্ষীয়া কুমারীর নাম মহালক্ষ্মী ।
- চতুর্দশ বর্ষীয়া কুমারীর নাম পীঠনায়িকা ।
- পঞ্চদশ বর্ষীয়া কুমারীর নাম ক্ষেত্রজ্ঞা ।
- ষোড়শ বর্ষীয়া কুমারীর নাম অম্বিকা ।
এদিন নির্বাচিত কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয় । হাতে দেয়া হয় ফুল, কপালে সিঁদুরের তিলক ও পায়ে আলতা । ঠিক সময়ে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে ষোড়শোপচারে পূজা করা হয় । চারদিক মুখরিত হয় শঙ্খ, উলুধ্বনি আর মায়ের স্তব-স্তুতিতে ।
কুমারী পূজার ইতিহাস
শাস্ত্র অনুসারে কুমারী পূজার উৎপত্তি হয় কোলাসুরকে বধ করার মধ্য দিয়ে । উপাখ্যানে বর্ণিত রয়েছে, কোলাসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করায় বাকি বিপন্ন দেবতাগণ মহাকালীর শরণাপন্ন হন । সে সকল দেবগণের আবেদনে সাড়া দিযে় দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন । এরপর থেকেই মর্ত্যে অর্থাৎ পৃথিবীতে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয় ।
কুমারী পূজার গুরুত্ব
কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন । বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত । কুমারী -- প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা । তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয় । এ সাধনপদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তির স্বরূপ ।