নতুন বাড়িতে প্রবেশ করার নিয়মাবলী
আমাদের পরম্পরা ভাবে চলে আসছে গৃহ নির্মাণ ও গৃহ প্রবেশের পূজার রীতি । শাস্ত্র মতে গৃহে যাতে সুখ শান্তি, সমৃদ্ধি এবং নিরাপদে বসবাস করার জন্যই গৃহ নির্মাণ / প্রবেশ কালে পূজার রীতির প্রচলন চলে আসছে । গৃহ নির্মাণ ও প্রবেশ কালে কিছু আচারবিধি রয়েছে ,যদি ও সব জায়গায় একই রকম নয়।নতুন গৃহে প্রবেশ করতে শাস্ত্রীয় বিধি বিধান মেনে চললে উপকার হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে, গ্রহগুলির প্রভাব আমাদের ওপর পড়ে। যার ফলে গ্রহের উপস্থিতি কাল, গল্ন–সময় আমাদের শুভ–অশুভের কারণ হয়ে দাঁড়ায় । নতুন গৃহ নির্মাণ হবার পর প্রথম যেদিন গৃহে প্রবেশ করা হয়, সেদিনটি বিচার করে গৃহপ্রবেশ করা উচিত । তবে যেগুলো বাধ্যবাধকতা মূলক নিম্নে সেগুলো বিস্তারিত বর্ননা করছি । শাস্ত্রীয় মতে, মানুষের জীবনে ৪টি মূল জিনিস রয়েছে যা আমাদের দরকার এবং আমাদের জন্য চেষ্টা করতেই হবে ।
যথা-
১.ধর্ম
২.অর্থ
৩.কাম
৪.মোক্ষ
ধর্ম
জীবনের ৪ টি জিনিস ৪ পর্যায়ে তার গুরুত্ব এক এক করে বেড়ে যায় । সর্বপ্রথম ধর্ম তথা সত্যকে জানা প্রয়োজন তারপর আসে দায়িত্ব । আর এই দায়িত্বের জন্য চাই অর্থ আর কাম হলাে ইচ্ছা কামনা বাসনা পূরণ করা,সব কিছু প্রাপ্তির পর যখন মানুষের ইচ্ছার সমাপ্তি ঘটে আর তখনই একমাত্র তার মােক্ষ প্রাপ্তি সম্ভবপর হয়ে উঠে । কারণ অতৃপ্ত আত্মা কখনাে মুক্তি পায় না । কামের বিষয়টা অনেক আগে থেকেই জন্ম নিতে থাকে যার পূর্ণতা আসে একমাত্র অর্থের আগমনের পরেই । যদি অর্থকে আমরা লক্ষ্য হিসেবে ধরি, তবেও কারণ হবে মা লক্ষ্মী । আবার অনেকেই মনে করেন অর্থ মানে শুধুই টাকা-পয়সা । কিন্তু তা মোটেই ঠিক না ।
লক্ষ্মী কত প্রকার ?
১.মহা লক্ষ্মী ধর্ম
২.ধন লক্ষ্মী – টাকা-পয়সা
৩. বীর লক্ষ্মী – দৈহিকবল এবং মনবল
৪.বিজয়া লক্ষ্মী – বিজয়
৫.বিদ্যা লক্ষ্মী – জ্ঞান
৬. গজ লক্ষ্মী - বাসস্থান, গাড়ি, পশু, রাজ্য
৭.সন্তান লক্ষ্মী সন্তান লাভ
৮.বাসস্থান লক্ষী
এই আট রূপ দেবী লক্ষ্মীর মানুষের পরম পূজ্য এবং জীবনের লক্ষ্য । কারণ,তার আশির্বাদেই সব সম্ভবপর হয় ।
এখানে : মাঙ্গলিক দোষ ও তার প্রতিকার
এই লক্ষ্য গুলাের মধ্য অন্যতম হলো বাসস্থান । বাসস্থান অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ তা মানুষের থাকার এবং সুরক্ষার কাজ করে থাকে । কোনাে স্থানে জমি ক্রয়ের পরেই তাতে সর্ব প্রথম মা মনসার পূজা করা হয় । মনসা উর্বরতার দেবী । যেহেতু জমিতে বহুপ্রকার সরিসৃপ থাকতে পারে এবং তা কৃষি কাজ বা গৃহাদি নির্মাণের সময় তাদের বাসস্থানের ক্ষতিও হতে পারে । এজন্য জমির উর্বরতার আশায় এবং সর্পজাতির গৃহে আঘাত আনায় ক্ষমা প্রার্থনার জন্য সর্ব প্রথম ক্রয়কৃত জমিতে দেবী মনসার পূজা করতে হয় । ফলে সর্প ভয় মােচন হয় । এরপর থানেশ্বরী বা ভূদেবীর পূজা করা আবশ্যক । গৃহ বা অন্যান্য কিছু নির্মাণ করতে গেলেই বাস্তু শাস্ত্রের জ্ঞান অত্যন্ত জরুরি । কারণ বাস্তুতন্ত্র মানুষের থাকার এবং সুরক্ষার জন্য কাজ করে । এছাড়াও বাসস্থান নির্মাণ করার জন্য বাস্তু শাস্ত্রের জ্ঞান আবশ্যক কারণ, বাড়ি শান্তিপ্রদ ও বাস্তু ঠাণ্ডা রাখার জন্য । বাস্তু দোষ মানুষের মনকে অনেক ভাবে প্রভাবিত করে থাকে ।
ভুলভাবে নির্মিত বাড়িতে হাওয়া বাতাসের চলাচল, আলাে প্রবেশ প্রভৃতি নানা সমস্যার দেখা যায় । তাই বাড়ি নির্মাণের আগে বাস্তুতন্ত্র জানা একান্ত আবশ্যক । এতে শুধু আপনার জীবন নয় আপনার পরিবারের ভবিষ্যতের জীবনের সৌভাগ্যও নির্ভর করে থাকে । কেমন করে ? ধরুন, আপনার ঘরের শৌচাগার যদি উত্তর দিকে হয় তাহলে উত্তরের হাওয়ার সঙ্গে আপনার ঘরে শৌচকার্যে সৃষ্ট জীবাণু ও দুর্গন্ধ বয়ে আনবে । আর এতে আপনার পরিবারের নানা রােগ এবং মনে অনেক নেতিবাচক প্রভাবে দেখা দিবে । এমন আরও অনেক নানা কারণে বাড়ি বা অন্যান্য স্থান নির্মাণে বাস্তু শাস্ত্রের প্রয়ােগ অতীব গুরুপ্তপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । ব্রহ্ম স্থান বা কেন্দ্র থাকা উচিৎ অন্যথা বৈঠক নির্মাণ করা যায় না ।
- ঈশান বা অগ্নি কোণে শৌচ কর্ম করা উচিৎ নয়, কেবল নৈঋত কোণে শৌচাগার হওয়া উচিৎ । শৈচাগারের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম মানা হয় ।
- পূর্ব, ঈশান বা উত্তর দিকেই দেবগৃহ করতে হবে ।
- রান্নাঘর সর্বদা অগ্নি কোণেই হওয়া উচিৎ ।
- পূর্ব, ঈশান বা অগ্নি কোণে মুখ্য দ্বার, অন্যথা পশ্চিমে । মুখ্য দ্বার সর্বদা অন্য সব দ্বার অপেক্ষা বড় হবে । চৌকাঠ উঁচুতে হবে ।
- সেপ্টিক ট্যাঙ্ক, জলাধার বা জলপ্রবাহ বায়ুকোণেই হবে । জলাধার কোনাে মতেই অগ্নিকোণে হবে না। অন্য কোনাে গর্ত একই নিয়ম মানতে হবে ।
- পশ্চিম দিকে স্টোর, সিঁড়িঘর হতে পারে, সিঁড়িঘরের নিচে স্টোর বা শৌচাগার করা যাবে না ।
- বাড়ির পূর্ব ও উত্তর দিক একটু খােলামেলা রাখতে হবে। মৎস পুরাণ ও বায়ু পুরাণের বর্ণনায় কোনাে এক কালে ভগবান শিব বাস্তুদেবতাকে বর দিয়েছিলেন যে, তার নির্ধারিত শাস্ত্র মত না মেনে যদি গৃহ আদি এমনকি মন্দিরও নির্মাণ করা হয় তাতে নানান দোষ দেখা দেবে । আর কেউ তাতে শান্তিতে থাকে পারবে না । কারণ মূলত এই যে, প্রতিটি সীমানা দেওয়া স্থানে বাস্তুদেবতার আলাদা করে আবির্ভাব ঘটে, ফলে প্রতিটি স্থানে তার দেহের সপ্তচক্রের প্রভাব দেখা যায় এবং বাস্তুদেবতার সর্বদা কুণ্ডলিনী জাগরিত থাকে বলে প্রতিটি ক্ষেত্রের আলাদা শক্তিমণ্ডল তৈরি হয়ে যায় । বাস্তুদেবতার মস্তক থাকে ঈশান কোণে আর পদ থাকে নৈঋত কোণে ফলে সহস্রার চক্রে তথা ঈশান কোণে দেবালয় । নৈঋত কোনকে রাক্ষস ক্ষেত্র বলা হয় । বসতবাড়ি নির্মাণে বাস্তু পূজা ও যজ্ঞ করা বাধ্যতামূলক যা আমাদের জীবনের একটা লক্ষ্য ।
গৃহপ্রবেশ কত প্রকার
গৃহপ্রবেশ ৩ প্রকার যথাঃ
১. সপূর্ব গৃহপ্রবেশ – বহুকাল পর ফিরে এলে এই গৃহপ্রবেশ করা হয় ।
২.অপূর্ব গৃহপ্রবেশ - নতুন বাড়ির ক্ষেত্রে এই গৃহপ্রবেশ করা হয় ।
৩.দ্বন্দ্ব গৃহপ্রবেশ – গৃহ নবায়ন করলে এই গৃহ প্রবেশ করা হয় ।
গৃহপ্রবেশ পূজা পদ্ধতি
বিধি অনুসারে প্রথমে নান্দিমুখ শ্রাদ্ধ এরপর দ্বার পূজা করতে হয় এবং বাড়ি পরিস্কার ও সুসজ্জিত রাখতে হয় । দরজায় আলপনা দিয়ে দুপাশে কলাগাছ লাগিয়ে দুটি দ্বার ঘট স্থাপন করা হয় । পূজা করে গৃহ কর্তার হাতে কুলদেবতা এবং কত্রীর হাতে পূর্ণ কলস দিয়ে গৃহে প্রবেশ করতে হয় ।
সবশেষে গৃহ শান্তি পূজা । এই পুজায় মােট ৫টি বেদি সাজাতে হবে । একটি নারায়ণ, একটি গণেশ ও একটি কুলদেবতার (লক্ষ্মী) । অন্য দুটির একটি হয় বাস্তু দেবতা ও দশদিকপালের এবং নবগ্রহের । পঞ্চগুড়ি সহ সর্বতােভদ্র মণ্ডলে নারায়ণের, স্বস্তিকা অঙ্কিত মণ্ডলে গণেশ ও অষ্টদল পদ্ম অঙ্কিত মণ্ডলে লক্ষ্মীর ঘট বসাতে হয়।এই ঘটই পরে নতুন গৃহে দেবী লক্ষ্মীর স্থায়ী ঘট হবে ।
গৃহপ্রবেশে সম্পূর্ণ পদ্ধতি পালন করা আবশ্যক তবে কিছু ক্ষেত্রে বাস্তুপূজা করলেও হয় । তুলসীগাছ না থাকলে তাতে লক্ষ্মীর প্রবেশ হয় না এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে । এর সাথেসাথে কিছু জায়গায় যেমন-বাংলাদেশ, পশ্চিম বঙ্গ বিহার, উড়িস্যা, আসাম অঞ্চলে বনদুর্গা বা মগধেশ্বরীর জন্য নৈবেদ্য উৎসর্গ করে থাকেন । শেষে দেবতার আসনের পাশে বা উপরে লাল রঙের ত্রিকোণ আকৃতির ধ্বজা লাগাতে হয়। আর এভাবেই ধর্মীয় মতে গৃহ নির্মাণ করলে /প্রবেশ করলে আপনাদের পরিবারে সুখসমৃদ্ধি বজায় থাকবে ।
এছাড়াও কিছু সাধারণ নিয়ম রয়েছে -
গৃহ প্রবেশের পূজার রীতি এটি আমাদের পরম্পরা ভাবে চলে আসছে । গৃহে যাতে সুখ ,শান্তি, সমৃদ্ধি,পূর্ণ থাকে এবং নিরাপদে বসবাস করার জন্যই গৃহ প্রবেশ কালে পূজার রীতি প্রচলিত । এই প্রবেশ কালে কিছু আচারের প্রচলন আছে ,যদি ও সব জায়গায় একি রকম নয়, এক প্রকার , আচার উল্লেখ করছি - বাড়ির প্রবেশদ্বারে কলাগাজ থাকবে ,জলপূর্ণ ঘট থাকবে ,বাছূর সহ গাভী থাকবে । আল্পনার দিয়ে সাজানো হবে । বাড়ির সদস্যরা গৃহ প্রবেশ কালে প্রত্যেকেই হয় আরাধ্য দেবতা অথবা প্রিয় বস্তু সামগ্ৰি হাতে নিয়ে প্রবেশ করবেন । গৃহ কর্তার হাতে শালগ্ৰাম শীলা বা নিজ আরাধ্য দেবতা বা গুরুদেবের ছবি থাকবে গৃহ কর্তীর কাছে থাকবে জলপূর্ণ ঘট । গৃহ প্রবেশের পূজাতে চার জন দেবতার পূজো হয়ে থাকে -
বাস্তু , চন্ডী ,শিব ,ও বিষ্ণু ।
বাস্তু — বসত ভিটাকে বলা হয় বাস্তু ভিটা । এর অধিপতি দেবতা হলেন বাস্তূ দেবতা । তাই বাস্তূ দেবতার পূজা করা হয় ।
চণ্ডী — নতূন গৃহের বাহ্যিক, অভ্যন্তরীণ, সব বিষয়ে অশুভ শক্তির বিনাশ সাধনের জন্য শ্রীশ্রী দুর্গার আরেক রূপ শ্রীশ্রী মা চণ্ডীর পূজা করা হয় ।
শিব — সব পূজাতেই পঞ্চদেবতার পূজা হয় । এই পঞ্চ দেবতার মধ্যে শিব ঠাকুর একজন । গৃহ প্রবেশের সময় বিশেষভাবে দেবাদিদেবের পূজা করা হয় । বিশেষ করে শিবলিঙ্গ তৈরী করে পূজা করা হয় ।
বিষ্ণু –– জগতের রক্ষাকর্তা হলেন বিষ্ণু । রক্ষাকারী হিসাবে বিষ্ণুদেবের পূজা করা হয় ।বিশেষ করে শালগ্ৰাম শিলার পূজা হয় । কেউ কেউ আবার কেবল মাত্র বিষ্ণু পূজা করেন । হরিনাম সংকীর্তনের ও আয়োজন হয়ে থাকে ।
গৃহ প্রবেশে পূজার গুরুত্ব
গৃহে বসবাস কারীগণের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল সাধনের জন্য উপরিউক্ত পূজা গুলি অনুষ্ঠিত হয়। যে জায়গাতে নতুন গৃহ তৈরী করা হয়, তার আশেপাশের লোকজনকে এবং আত্মীয়স্বজন ,বন্ধু বান্ধব সকল কে নিমন্ত্রণ করা হয়। এতে নতুন বাড়ি এবং নতুন মানুষদের ঐ এলাকায় পরিচিত হওয়া অনেক সহজ হয়ে যায় ।
আরও জানুন
হিন্দুধর্ম সম্পর্কে বিখ্যাত ব্যক্তিদের উক্তি
বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ১০ সেলিব্রিটি যারা হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছেন
পূজায় মঙ্গল ঘট স্থাপন করার কারণ
হিন্দুরা কেন প্রতিমা বিসর্জন দেয় ?
Hare Krishna
ReplyDeleteহরে কৃষ্ণ
Delete