হিন্দু মুনি-ঋষিরা কি মাংসাহার করতেন ?
অনেকের মনে হতে পারে যে, বৈদিক যুগে ক্ষত্রিয়রা আমিষ আহার করলেও ব্রাহ্মণ ও মুনি ঋষিরা নিরামিষই আহার করতেন । নিরামিষ যে খেতেই হবে এমন কথা কিন্তু হিন্দুধর্মের কোথাও বলা নেই ।
মহর্ষি অগস্ত্যের মাংসাহারের প্রমাণ
কিন্তু রামায়ণ ও মহাভারতে বর্ণিত ইল্বল ও বাতাপির ঘটনা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করে যে, প্রাচীন কালে ব্রাহ্মণ ও মুণি ঋষিরাও মাংসাহার করতেন । এই প্রসঙ্গে বাল্মীকি রামায়ণের অরণ্যকাণ্ডের দশম সর্গে বলা হচ্ছে যে, রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা নানা বনে ভ্রমণ করতে করতে অগস্ত্য মুনির আশ্রমে উপনীত হলেন এবং সেখানেই তারা ইল্বল ও বাতাপির উপাখ্যান শুনলেন । এককালে সেইখানেই তারা ইল্বল ও বাতাপির উপাখ্যান শুনলেন । এককালে সেইখানে ইল্বল ও বাতাপি নামে দুই দানব ভাই বাস করত ।
ইল্বল ব্রাহ্মণ সেজে মিথ্যা শ্রাদ্ধের নাম করে অনেক ব্রাহ্মণকে নিমন্ত্রণ করে আসতাে । নিমন্ত্রিতরা আসার আগে বাতাপি মায়াবলে নিজেকে একটি ছাগলে রূপান্তরিত করত এবং ইল্বল তাকে কেটে রান্না করে ব্রাহ্মণদের খেতে দিত । সবার খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে ইল্বল বাতাপি বাতাপি বলে চীৎকার করত এবং সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বাতাপি ব্রাহ্মণদের পেট চিড়ে বেড়িয়ে আসত । ফলে সব নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণরাই মারা যেত । এই দুঃখজনক ঘটনা শুনে ঋষি অগস্ত্য একদিন ইল্বলের বাড়িতে অতিথি হিসাবে উপস্থিত হলেন । ইল্বল যথারীতি বাতাপিকে ছাগল বানিয়ে তার মাংস অগস্ত্যকে খেতে দিল । খাওয়া দাওয়া সারা হলে ইন্বল বাতাপি বাতাপি বলে চীৎকার শুরু করল । ঋষি অগস্ত্য তখন বললেন,
কুতো নিস্ক্রমিতুং শক্তর্ময়া জীর্ণস্য রক্ষসঃ।।
ভ্রাতুন্তু মেষরূপস্য গতস্য যমসাদনম্।। (অরণ্য-১১/৬৪)
-- অর্থাৎ ছাগলরূপী তােমার ভাই আর কোথা থেকে আসবে! আমি এতক্ষণে তাকে জীর্ণ করে ফেলেছি, তাই সে এখন যমলােকে পৌঁছে গিয়েছে ।
এই ঘটনা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, শুধু ব্রাহ্মণরাই নয়, অগস্ত্যের মত মহর্ষিরাও সেই কালে মাংসাহারী ছিলেন ।
মনুসংহিতায় ব্রাহ্মণদের মাংসাহারের প্রমাণ
মনুসংহিতা বহু শ্লোকের মধ্য দিয়ে মাংসাহার অনুমােদন করছে । বিশেষ করে শ্রাদ্ধে মাংসাহার অবশ্য কর্তব্য ছিল । এ ব্যাপারে কয়েকটি শ্লোক নীচে দেওয়া গেল :
দ্বৌ মাসৌ মৎস্যমাংসেন ত্ৰীন মাসান্ হারিণেন তু।
ঔরন্দ্রেণাথ চতুরঃ শাকুনেনাথ পঞ্চ বৈ ।। (মনুঃ৩/২৮৮)
-- অর্থাৎ, পাঠীনাদি মৎস্যের মাংস প্রদত্ত হলে তা দিয়ে পিতৃলােক দুই মাস, হরিণমাংস দিয়ে তিন মাস, মেষমাংসে চার মাস এবং দ্বিজাতি ভক্ষ্য পক্ষী (পাখি) মাংসে পাঁচ মাস যাবৎ পরিতৃপ্ত থাকেন । (অনুবাদ-শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন, মনুসংহিতা, সংস্কৃত পুস্তক ভান্ডার, কলকাতা-৬, ১৯৯৩) ।
[মনুসংহিতা pdf Download Link]
ষণ্মাসাংচ্ছাগমাংসেন পার্ষতেন সপ্ত বৈ।-- অর্থাৎ, ছাগলের মাংস দ্বারা তারা ছয়মাস তৃপ্ত থাকেন, এখানে চিত্রিত দশ মাসাংস্তু তৃল্যতে বরাহমহিষামিষৈঃ।।
অষ্টাবেণস্য মাংসেন রৌরবেণ নবৈব তু৷৷ (৩/২৭০)
শশঅর্থাৎ, বরাহ ও মহিষের মাংস শ্রাদ্ধে প্রদত্ত হলে পিতৃলােক দশমাস কাল তৃপ্ত থাকেন এবং শশ ও কচ্ছপমাংস দ্বারা তাদেরর এগারো মাস পর্যন্ত তৃপ্তি থাকে। (অনুঃ ঐ)
কালশাকং মহাশল্কাঃ খড়গলােহামিষং মধু।
আনন্ত্যায়ৈব কল্পতে মন্যুন্নানি চ সৰ্ব্বশঃ।। (মনুঃ ৩/২৭২)।
কালশাক নামক শাক, যে সকল মৎস্যে (মাছ) বড় বড় শল্ক বা আঁইষ আছে, সেইরকম মৎস্য, গন্ডারের মাংস, রক্তবর্ণ ছাগলের মাংস, মধু এবং নীবারাদি মুনিজন-ভক্ষ্য অন্ন—এই সকল দ্রব্য দ্বারা পিতৃলােকের অনন্তকালের জন্য তৃপ্তি সাধিত হয় । (অনুঃ ঐ)।
আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হল, মনুস্মৃতি (৫/৩৫) শ্লোকের মাধ্যমে মাংস না খাওয়াকে অপরাধ বলে গণ্য করছে এবং সেখানে বলা হচ্ছে :
নিযুক্তস্ত যথান্যাং যাে মাংসং নাত্তি মানবঃ।
স প্ৰেত্য পশুতাং ষাতি সম্ভবানেকবিংশতিণ্৷৷ (৫/৩৫)
অর্থাৎ, যে মানুষ দেবকার্যে যথাশাস্ত্র নিযুক্ত হয়ে মাংস ভােজন না করে । সে মৃত্যুর ক্রমে পরবর্তী একুশ জন্ম পশুযোনি প্রাপ্ত হয় । (অনুঃ ঐ, পৃঃ ১৩৪)।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, মাংসাহারী যােদ্ধা ক্ষত্রিয় রাজা শ্রীরামচন্দ্র আজ এক জন নিরামিষ দেবতায় পরিণত হয়েছেন । এটা অতি সত্য কথা যে, কোন নিরামিষভােজী ব্যক্তি ডাল যােদ্ধা হতে পারে না । এটাও ধ্রুব সত্য যে, প্রাচীন কালে এই দেশে ক্ষত্রিয়দের জন্য মাংসাহার ও মদ্য পান বৈধ ছিল । কাজেই এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই যে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র মাংসাহারী ছিলেন! এবং বাল্মীকি রামায়ণে এই ধ্রুবসত্যটিকেই বিভিন্ন শ্লোকের মাধ্যমে বলা হয়েছে ।
হিন্দু ধর্মগুরুদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দই হলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি হিন্দু জাতির পতন ও তার বিগত হাজার বছরের পরাধীনতার কারণগুলাে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন ।
হিন্দু ধর্ম নিয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের উক্তি