আমলকী একাদশীর মাহাত্ম্য
আমলকী একাদশী যুধিষ্ঠির বললেন-হে শ্রীকৃষ্ণ! মহাফলদাতা বিজয়া একদশীর কথা তো শুনলাম । এখন ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী নামে বিখ্যাত একাদশীর মাহাত্ম্য আমাকে দয়া করে বলুন ।
শ্রীকৃষ্ণ বললেন-হে মহাভাগ যুধিষ্ঠির! মান্ধাতার প্রশ্নের উত্তরে মহাত্মা বশিষ্ঠ এই একদাশীর মহিমা কীর্তন করেছিলেন আপনার কাছে । এখন আমি সেই কথা বলছি ।
এই একাদশীর নাম ‘আমলকী’ । বিষ্ণুলােক প্রদানকারী রূপে এই একাদশী বিশেষভাবে মহিমান্বিত । এই একাদশীর দিন আমলকী বৃক্ষের তলে রাত্রি জাগরণ করলে সহস্র গাভী দানের ফল লাভ হয় ।
হে পান্ডুপুত্র! সৃষ্টিকালে ব্রহ্মার রাত্রিতে দৈনন্দিন প্রলয় উপস্থিত হলে স্থাবর জঙ্গমসহ দেবতা, অসুর ও রাক্ষস সবকিছুর বিনাশ হয় । তখন ভগবান সেই কারণে সমুদ্রে অবস্থান করেন । তাঁর মুখপদ্ম থেকে চন্দ্রবর্ণের একবিন্দু জল ভূমিতে পড়ে । সেই জলবিন্দু থেকে একটি বিশাল আমলকী বৃক্ষ উৎপন্ন হয় । এই বৃক্ষের স্মরণ মাত্র গাে-দানের ফল, দর্শনে তার দ্বিগুণ এবং এর ফলভক্ষণে তিনগুণ ফল লাভ হয় । এই বৃক্ষে ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর মহেশ্বর সর্বদা অবস্থান করেন । এর প্রতিটি শাখা-প্রশাখা ও পাতায় ঋষি, দেবতা, ও প্রজাপতিগণ বাস করেন । এই বৃক্ষকে সমস্ত বৃক্ষের আদি বলা হয় এবং তা পরম বৈষ্ণব রূপে বিখ্যাত । অতএব এই শ্রেষ্ঠ ব্ৰত সকলেরই পালনীয় । এখন এই ব্রতের একটি অদ্ভুত ইতিহাস আপনার কাছে বর্ণনা করছি ।
রাজা বিদুরথের উপাখ্যান
প্রাচীনকালে ‘বৈদিশ’ নামে এক প্রসিদ্ধ নগর ছিল । এই নগরে ‘চৈত্ররথ’ নামে এক রাজা রাজত্ব করতেন । চন্দ্রবংশীয় পাশবিক রাজার পুত্ররূপে তিনি জন্মগ্রহণ করেন । তিনি অত্যন্ত শক্তিমান ও ঐশ্বয্যশালী ছিলেন । শাস্ত্রজ্ঞানেও তিনি ছিলেন সুনিপুণ । তার রাজ্যের সর্বত্রই মনােরম আনন্দপূর্ণ এক দিব্য পরিবেশ লক্ষ্য করা যেত । তার প্রজারা ছিলেন বিষ্ণুভক্তিপরায়ণ । সকলেই একাদশী ব্রত পালন করতেন । তার রাজ্যে কোন অভাব অমঙ্গল ছিল না । এইভাবে প্রজাদের নিয়ে রাজা চৈত্ররথ সুখে দিনযাপন করতে থাকেন ।
একসময় ফাল্গুনী শুক্লপক্ষের দ্বাদশীযুক্তা আমলকী একাদশী তিথি সমাগত হওয়ায় রাজ্যের সকলেই এই ব্রত পালনের সংকল্প করলেন । ঐদিন প্রাতঃ স্নানের পর প্রজাদের নিয়ে রাজা ভগবান শ্রীবিষ্ণুর মন্দিরে যান । সেখানে সুবাসিত জলপূর্ণ কলস, ছত্র, বস্ত্র, পাদুকা, পঞ্চরত্ন ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে স্থাপন করেন । তারপর ধূপ-দীপ দিয়ে যত্ন সহকারে মুনি-ঋষিদের দ্বারা শ্রীপরশুরাম মূর্তি সমন্বিত আমলকীর পূজা করেন । হে রেণুকার সুখবর্ধক! হে ধাত্রি! হে পাপবিনাশিনী আমলকী! তােমাকে প্রণাম । আমার অর্ঘ্যজল গ্রহণ কর । এইভাবে দিনে যথাবিধি পূজা স্তবস্তুতি নৃত্যগীত করে রাজা ভক্তিভরে সেই বিষ্ণুমন্দিরে রাত্রি জাগরণ করতে লাগলেন ।
এমন সময় দৈবযােগে একটি ব্যাধ সেখানে উপস্থিত হয় । পূজার সামগ্রী সহ বহু ব্যক্তিকে একত্রে রাত্রি জাগরণ করতে দেখে সে কৌতূহলাক্রান্ত হল । সে ভাবল—এসব কি ব্যাপার ? বিষ্ণু মন্দিরে প্রবেশ করে সে বসে পড়ল । কলসের উপরে স্থাপিত বিষ্ণুমূর্তি দর্শন করল । ভগবান বিষ্ণু এবং একাদশীর মাহাত্ম্যও সে মনােযােগ দিয়ে শুনল । সারাদিন ঐ ব্যাধ কিছুই আহার করেনি । এইভাবে ক্ষুধায় কাতর হয়ে সেখানে সে রাত্রি জাগরণ করল ।
পরদিন প্রজাসহ রাজা নগরের দিকে যাত্রা করলেন । সেই ব্যাধও তার গৃহে ফিরে গেল । এরপর একসময় ব্যাধের মৃত্যু হল । একাদশীতে রাত্রি জাগরণ ব্রত প্রভাবে সেই ব্যাধ পরবর্তী জন্মে এক রাজ্যের অধীশ্বর রূপে নিযুক্ত হল ।
সেসময় ভারতবর্ষে জয়ন্তী নামে এক নগরী ছিল । সেখানে বিদূরথ নামে এক রাজা বাস করতেন । ঐ ব্যাধ বিদুরথ রাজার মহাবলী পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন । তার নাম হয় বসুরথ । এক লক্ষ গ্রামের আধিপত্য তিনি লাভ করলেন । তিনি ছিলেন সূর্যের মতাে তেজস্বী, চন্দ্রের মতো কান্তিমান আর পৃথিবীর মতো ক্ষমাশীল । সদগুণে ভূষিত বিদুরথ পরম বিষ্ণুভক্তি পরায়ণ হন ।
এই মহাদাতা রাজা একবার শিকার করতে গিয়ে পথ ভুলে যান । গভীর জঙ্গলের মধ্যে ক্ষুধায় পীড়িত হয়ে তিনি ক্লান্তিবশতঃ শুয়ে পড়েন । এমন সময় কতগুলি পর্বতনিবাসী ম্লেচ্ছরা তার কাছে এসে নানাভাবে উৎপীড়ন করতে থাকে । রাজাকে তাদের শত্রু মনে করে তারা তাকে হত্যা করতে চেষ্টা করে । “পূর্বে এই রাজা আমাদের পিতা-মাতা, পুত্র-পৌত্র সবাইকে মেরে ফেলেছে । আমাদের গৃহছাড়া করেছে ।" এইরকম বলতে বলতে ম্লেচ্ছরা রাজাকে হত্যা করতে উদ্যত হয় । তারা বিভিন্ন অস্ত্র-শস্ত্রে তাকে আঘাত করতে থাকে ।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় । রাজার কোন ক্ষতিই তারা সাধন করতে পারেনি । তখন রাজার শরীর থেকে নানা অলঙ্কারে বিভূষিতা এক পরমা সুন্দরী স্ত্রী মূর্তি আবির্ভূত হন । মহাশক্তিধারিনী ঐ নারী অল্প সময়ের মধ্যেই সকল পাপী ম্লেচ্ছদের নিধন করলেন । রাজার নিদ্রাভঙ্গ হল । এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ড দেখে মহারাজ বিদুরথঅত্যন্ত বিস্মিত হলেন ।
তিনি বলতে লাগলেন—আহা! আমার শত্রুদের হত্যা করে কে । আমার প্রাণ রক্ষা করল, এমন কৃপালু কে আছে ? আমি তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি । এমন সময়ে দৈববাণী হল—ভগবান ব্যতীত শরণাগতকে রক্ষা করবার আর কে আছে ? তিনিই শরণাগতের পালনকর্তা । দৈববাণী শুনে তিনি ভক্তিযুক্ত চিত্তে রাজ্যে ফিরে এলেন । তারপর প্রজাসহ মহাসুখে ইন্দ্রের মতাে নিষ্কণ্টক রাজ্য ভােগ করতে লাগলেন । বশিষ্ঠ বললেন-হে রাজন! যে মানুষ এই পরমোত্তম আমলকী একাদশী ব্রত পালন করেন তিনি নিঃসন্দেহে বিষ্ণুলােকে গমন করেন ।
আরও জানুন :
হিন্দুধর্মের সবচেয়ে শক্তিশালী ৮ জন দেবতা
বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ১০ সেলিব্রেটি যারা হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছেন