শ্রীমদভগবদগীতা আমাদের কি শিক্ষা দেয়
মানব ও প্রকৃতির এই বন্ধন ও পারস্পরিক নির্ভরতার কথাই ভগবত গীতার উপদেশে আছে । গীতার উপদেশে যজ্ঞের কথা বলা হয়েছে । এই যজ্ঞের বিধি নিয়ম এমন যে তা প্রাকৃতিক চক্রকে অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে, গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে, “পরমা প্রকৃতি আমাদের যে সম্পদ দিয়েছেন কেউ যদি তা ফিরিয়ে না দেয় তবে সে চোর ছাড়া আর কি ?” সত্যিই, প্রকৃতি আমাদের নির্মল বাতাস শুদ্ধ পানীয় জল দিয়েছে । তাই বাতাস, জলকে নির্মল পবিত্র রাখা আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব । মাটিতে জৈব প্রক্রিয়া ফসল ফলাতে মানুষকে সাহায্য করে । প্রকৃতির এই জৈব প্রক্রিয়া খাদ্য সরবরাহ করে মানবের জীবন- চক্রকে অব্যাহত রেখেছে । প্রাকৃতিক জৈব-প্রক্রিয়ায় বিষ ছড়িয়ে তাকে ধ্বংস করলে জীবন-চক্রকেই ধ্বংস করা হবে । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাই গীতার বাণীতে বলেছেন, “যে ব্যক্তি প্রকৃতির জীবনচক্রে বাধা দেয় সে ইন্দ্রিয় সুখে আসক্ত মহাপাপী ।” মাটি, জল, বাতাসে দূষণের বিষ ছড়ালে প্রাকৃতিক জীবনচক্র বিঘ্নিত হয় । তাই গীতার মহান উপদেশ, ইন্দ্রিয় সুখভােগর ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করাে । তােমার লােভ, ভােগেচ্ছা প্রকৃতিকে ধ্বংস করবে । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, বিশ্ব প্রকৃতির নিয়ন্ত্রক পুরুষােত্তম সকলের পরম মিত্র । তিনি কাউকে ঘৃণা করেন না । তিনি সর্বদা হিতকারী ।
গীতার বাণী অনুসারে সর্বজনের হিত চিত্তা সত্য হলে প্রাকৃতিক সম্পদ শােষণ বা লুণ্ঠনের প্রশ্ন আসে না । যেমন দুগ্ধবতী গাভীকে মাংসের জন্য হত্যা করা যেতে পারে । হত্যা করলে বড় জোর একবারই মাংস পাওয়া যেতে পারে । গাভীটিকে আর পাওয়া যাবে না । অথচ দুগ্ধবতী গাভীটিকে সযত্নে রক্ষা করলে দীর্ঘ বহু বছর ধরে দুধের অমৃতধারা ভােগ সম্ভব । ভারতীয় হিন্দু এই সহজ সত্যটি উপলব্ধি করেছিল । হিন্দু তাই গাে সম্পদকে রক্ষা করেছে । মাংসের লােভে হত্যা করাকে অধর্মীয় মহাপাপ বলে ঘােষণা করেছে । পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় তাঁর “একাত্ম মানবতাবাদ” প্রসঙ্গে বলেছেন, “প্রকৃত সভ্যতার বিস্তার কখনাে প্রকৃতিকে শােষণ করে হয় না । প্রকৃতিকে রক্ষা করে তাকে সযত্নে পুষ্ট করেই তার জয়যাত্রার রথ এগিয়ে চলে । প্রকৃতির দানকে যথাযযাগ্য মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করেই মানব জীবনকে সচল রাখার পদ্ধতি ও নীতিই সর্বশ্রেষ্ঠ পথ ।”
হিন্দু ধর্ম দর্শন
হিন্দু দর্শনের বাণী, গীতা ও উপনিষদের উপদেশগুলিকে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে যুক্ত করতেই তাকে ধর্মাচরণের অঙ্গ করা হয়। ধর্ম, হিন্দুদর্শন এবং সমাজের প্রধান যােগসূত্র । ধর্মচরণের মধ্যেই এই মহান দর্শনের উপলব্ধি বাস্তবে প্রতিফলিত হয়েছে । ধর্মীয় অনুশাসনে হিন্দুর কর্তব্য ও অকৰ্ত্তব্যের কথা সহজভাবে বলা আছে । এই কৰ্ত্তব্য ও অকর্তব্যের তালিকা পড়লে অবাক হতে হয় এই দেখে যে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের আচার আচরণের কথা ভাবা হয়েছে ।
সংসারে সরল ও সত্য পথে চলতে গেলে কেমন আচরণ আমাদের করা উচিত তার পুঙ্খানুপুঙ্খ উপদেশ একমাত্র হিন্দু ধর্মীয় অনুশাসনেই পাওয়া যায় । হিন্দু ধর্মে এই কর্তব্য ও অকর্তব্যের দৈনন্দিন তালিকা অনুসরণের মধ্যেই প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার বীজমন্ত্র আছে । এমন অনেক কর্তব্য-কর্মের কথা বলা আছে যাতে বন জঙ্গল ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। ভূমিক্ষয় রােধ হয় । জল ও বাতাস নির্মল থাকে। জমির উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি পায় । অকারণ পশু হত্যায় ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকে ।
আরও পড়ুন :