হিন্দুধর্ম ও অবতারবাদ
হিন্দুধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অবতারবাদে বিশ্বাস । অবতার-এর অর্থ হচ্ছে উপর থেকে নিচে নামা বা অবতরণ করা । স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য ধর্ম অনুশীলনের ব্যবস্থা রেখেছেন । ধর্মের অসাধারণ গুণ! ধর্মকে যিনি রক্ষা করেন, ধর্ম তাকে রক্ষা করে ‘ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ'। তবে মনুষ্যসমাজে মাঝে মাঝে ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা দেখা দেয় । ধার্মিকদের জীবনে নেমে আসে । নিপীড়ন-নির্যাতন । দুষ্কৃতকারীদের অত্যাচার-অনাচার সমাজজীবনকে কলুষিত করে তােলে । এরূপ অবস্থায় ভগবান স্বয়ং মনুষ্যাদির মূর্তি ধারণ করে পৃথিবীতে নেমে আসেন । একেই বলা হয় অবতার । আর অবতার সম্পর্কে যে দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা, তা অবতারবাদ নামে পরিচিত ।
অবতারের উদ্দেশ্য দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ সাধন, সাধু-সজ্জনদের দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত করা এবং ধর্ম সংস্থাপন করা । এই অবতারবাদের সূচনা লক্ষ করা যায় পৌরাণিক যুগে। অনন্ত শক্তিধর ঈশ্বর জীবের ন্যায় দেহ ধারণ করে আবির্ভূত হন । এই আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে অবশ্য অসীম ঈশ্বরের ধারণায় কোনাে ছেদ ঘটে না । ঈশ্বর হচ্ছেন চৈতন্যময় সত্তা । তিনি চৈতন্যস্বরূপ । তিনি অসীম সসীম সকল অবস্থাতেই থাকতে পারেন । কাজেই অবতার সসীম হয়ে দেহ ধারণ করে এলেও তার মধ্যে ঈশ্বরীয় শক্তি থাকে । জীবদেহ ধারণ করলেও তিনি এবং জগৎ কারণ ব্রহ্ম এক এবং তাঁর এই স্থূল দেহ ধারণ একটি মায়ার খেলা মাত্র ।
অবতারের প্রকারভেদ
এই অবতার তিন পর্যায়ের হয়ে থাকে । যথা- গুণাবতার, লীলাবতার ও আবেশাবতার । ব্রহ্মা, পরমেশ্বর বিষ্ণু ও মহেশ্বর এই তিন দেবতারূপে অবতীর্ণ হয়ে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার করেন । এরা পরমেশ্বরের গুণাবতার । আবার পৃথিবীতে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ প্রভৃতি স্থূল দেহধারী জীবের মূর্তিতে অবতীর্ণ হয়ে তাঁরা যে কর্মকাণ্ড করেন তাকে লীলাবতার বলা হয়। শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমেশ্বরের জ্ঞানাদি শক্তির দ্বারা আবিষ্ট । এ মহাপুরুষেরা আবেশাবতার । বিষ্ণুর দশাবতারের কথা বলা হয়েছে। এঁরা হলেন- মৎস্য, কুর্ম, বাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম (শ্রীরামচন্দ্র), বলরাম, বুদ্ধ এবং কল্কি ।
পৌরাণিক কাহিনী থেকে জানা যায়, বেদ প্রলয় পয়ােধি জলে নিমগ্ন হলে ভগবান বিষ্ণু মৎস্যরপ ধারণ করে বেদ উদ্ধার করেন । এরপর পৃথিবী জলপ্লাবিত হলে কূর্মরূপে ভগবান পৃথিবীকে পৃষ্ঠে ধারণ করেন । এটি কূর্ম অবতার । পুনরায় পৃথিবী জল দ্বারা প্লাবিত হলে ভগবান বরাহরূপে পৃথিবীকে দন্তে ধারণ করেন ।
নৃসিংহরূপে অবতীর্ণ হয়ে তিনি অত্যাচারী দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন এবং রক্ষা করেন ভক্ত প্রহ্লাদকে । ভগবান বামনরূপে অবতীর্ণ হয়ে রাজা বলির দর্প চূর্ণ করেন । ক্ষত্রিয় প্রতাপে পৃথিবী নিপীড়িত হলে তিনি পরশুরামরূপে পৃথিবীকে একুশবার ক্ষত্রিয়হীন করেন । অত্যাচারী রাজা রাবণের বিনাশ সাধন করেন শ্রীরামচন্দ্র অবতার । হলধর বলরাম হল কর্ষণ করে পৃথিবীকে অমৃতময় করেন । একইসঙ্গে তিনি অন্যায়কেও দমন করেন । বুদ্ধরূপে তিনি অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী ও করুণার নৈতিক শিক্ষায় সকলকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াসী হন । কলিযুগের শেষ ভাগে যখন অধর্ম ও অসত্যের প্রভাব প্রকট হয়ে উঠবে তখন ভগবান বিষ্ণু কল্কিরূপে অবতীর্ণ হয়ে জগতে ধর্ম ও সত্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন । অবতারের সংখ্যা অবশ্য নির্ণয় করা সম্ভব নয় । শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে, অবতার অসংখ্য । এখানে প্রধানত দশ অবতারের কথা বলা হয়েছে ।
আরও পড়ুন :