ঈশ্বর জীবের আত্মারূপে জীবের মধ্যে বাস করেন । তাই জীবের সেবা করলে ঈশ্বরেরই সেবা করা হয় । মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ এরা সবাই জীব । এদের সেবাও জীব সেবা । উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে, তাই ব্যাপক অর্থে এরাও জীব । এদের সেবাও জীব সেবা ।
জীবকে সেবা করার প্রেরণার পশ্চাতে রয়েছে ঈশ্বরের সর্বাত্মক অনুভূতি । ঈশ্বর সর্বব্যাপী, সব কিছুর মধ্যেই ঈশ্বর বিদ্যমান । উপনিষদের যুগে বলা হয়েছে, “সবং খন্বিদং ব্রহ্মঃ' - সব কিছুই ব্ৰহ্ম । গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘ঈশ্বরঃসর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি’-হে অর্জুন, ঈশ্বর সকল প্রাণীর হৃদয়ে অবস্থিত। জীব সেবাই ঈশ্বর সেবা । সুতরাং ঈশ্বরকে সেবা করতে হলে জীবকে সেবা করতে হবে; জীবকে ভালােবাসতে হবে ।
ঈশ্বর আত্মারূপে সব জীবের মধ্যেই আছেন, আর সেই ঈশ্বর সবার সেব্য । এই বােধ যখন জন্মে, তখন অপরের অনুভূতির সঙ্গে নিজের অনুভূতি এক হয়ে যায় । এ অবস্থায় মানুষ প্রতিটি জীবের আনন্দ বেদনাকে নিজের আনন্দ বেদনা বলে অনুভব করে । ফলে অপরের দুঃখ বেদনাকে নিজের দুঃখ বেদনার ন্যায় দূর করতে প্রয়াসী হয় । তখন সে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, এমন কি নিজের জীবন পর্যন্ত পরের সেবায় উৎসর্গ করতে দ্বিধাবােধ করে না । এমন এক আদর্শ জীব সেবার দৃষ্টান্ত রয়েছে সিদ্ধার্থ ও দেবদত্তের কাহিনীর মধ্যে ।
সিদ্ধার্থ হল গৌতম বুদ্ধের বাল্য নাম । ছেলেবেলা থেকেই তার হৃদয় ছিল করুণায় ভরা । পশু, পাখি, মানুষ সবার দুঃখেই তার হৃদয় কেঁদে ওঠে । কারও দুঃখ কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারেন না ।
এক দিন বিকেল বেলা বালক সিদ্ধার্থ বাগানে বসে আছেন । এমন সময় হঠাৎ তার পায়ের কাছে এসে পড়ল একটি হাঁস। হাঁসটির গায়ে একটি তীর বিদ্ধ হয়ে রয়েছে । আর সে ক্ষতস্থান থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে । এ দৃশ্য দেখে সিদ্ধার্থের হৃদয় করুণায় ভরে গেল । তিনি সস্নেহে হাঁসটির দেহ থেকে তীরটি খুলে ফেললেন এবং গভীর সহানুভূতির সাথে হাঁসটির শুশ্রষা করতে লাগলেন ।
তখন সেখানে দৌড়ে এসে উপস্থিত হলেন সিদ্ধার্থের খেলার সাথী দেবদত্ত । তিনি বললেন, “সিদ্ধার্থ, হাঁসটি আমি তীরবিদ্ধ করেছি; হাঁসটি আমার । তুমি এটি আমায় দিয়ে দাও ।”
সিদ্ধার্থ বললেন, “না দেবদত্ত, সেটি হয় না । আমি হাঁসটি তােমার হাতে দিতে পারি না ।”
দেবদত্ত বললেন-“কেন দিতে পার না ? এ হাঁসটি তাে তােমার নয় । এটি বুনাে হাঁস । আমি এটিকে তীরবিদ্ধ করেছি; হাঁসটি আমার । আমাকে এটি দিয়ে দাও” ।
সিদ্ধার্থ বললেন, “দেবদত্ত, তুমি এ কী বলছ ? তােমার কি সুখ দুঃখের অনুভূতি নেই ? তােমাকে আঘাত করলে তুমি যেমন ব্যথা বােধ কর, এ হাঁসটিও তেমনি তােমার শরে আহত হয়ে কষ্ট পাচ্ছে; এখন আমাদের উচিত এর কষ্ট দূর করার ব্যবস্থা করা ।"
দেবদত্ত এবার রেগে বলে উঠলেন, “সিদ্ধার্থ, তােমাকে আবার বলছি, হাঁসটি আমাকে দিয়ে দাও ।”
ধীর শান্তভাবে সিদ্ধার্থ বললেন, “দেবদত্ত, তুমি রেগে যাচ্ছ কেন ? নিজের দুঃখ চিন্তা করে পরের দুঃখ বােঝার চেষ্টা অনুভূতি আছে, আছে প্রাণের প্রতি ভালােবাসা । আর জেনে রাখ, কর । হাঁসটিরও তাে তােমার আমার মত সুখ দুঃখের অনুভূতি আছে, আছে প্রাণের প্রতি ভালোবাসা । জীবন নাশ করার চেয়ে জীবন রক্ষা করা অনেক বড় কাজ । সুতরাং হাঁসটি আমি তােমার হাতে মৃত্যুর মুখে দিতে পারি না; এর পরিবর্তে তুমি যা চাইবে তাই তােমাকে দেব; তবু হাঁসটি আমি ছাড়ব না ।”
আহত হাঁসটি রক্ষার ব্যাপারে সিদ্ধার্থের দৃঢ়সংকল্প দেখে দেবদত্ত স্তম্ভিত হলেন । জীবের প্রতি সিদ্ধার্থের করুণা তাঁর হৃদয়কেও স্পর্শ করল ।
সিদ্ধার্থ হাঁসটিকে সুস্থ করে আকাশে উড়িয়ে দিলেন ।