মোক্ষলাভ বা ঈশ্বর প্রাপ্তিকে মানব জীবনের পুরুষার্থ বলা যেতে পারে । এই মোক্ষলাভের জন্যই যুগে-যুগে আর্য ঋষিগণ বিভিন্ন সাধন পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন । কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তিযোগ এগুলোর যে কোন একটি পথ অনুসরণ করলেই মোক্ষলাভ সম্ভব ।
কর্মযোগ
যা কিছু করা হয় তাকে কর্ম বলে । কিন্তু ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য যে কর্ম করা হয় তাকে বলে কর্মযোগ । ভিন্ন কথায় নিষ্কাম কর্ম । কর্মকর্তা যখন মনে করেন, এই বিশ্বজগৎ স্বয়ং ঈশ্বরের কর্মক্ষেত্র, সমস্ত কর্মই ঈশ্বরের কর্ম, কর্ম থেকে উৎপন্ন ফলও ঈশ্বরেরই প্রাপ্ত, ঈশ্বর তাকে দিয়ে কর্ম করিয়ে নিচ্ছেন মাত্র, তখন সেই উপলব্ধি থেকে উদ্ভুত কর্মকে বলে নিষ্কাম কর্ম । নিষ্কাম কর্মের তিনটি লক্ষণ --
১. ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ
২. কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ
৩. কর্মফল ঈশ্বরে সমর্পণ
সকাম কর্ম
অপরদিকে কামিনী-কাঞ্চন যুক্ত যে কর্ম তাকে বলে সকাম কর্ম । সকাম কর্ম নিষ্কাম কর্মের বিপরীত । সকাম কর্মের বৈশিষ্ট হলো --
১. কর্তা মনে করেন কর্মটি আমার
২. কর্তা মনে করেন কর্ম আমার এবং সেটি আমিই করি
৩. কর্তা মনে করেন কর্মের ফলাফল ভাগীও আমি
সকাম কর্মে কর্তার কর্তৃত্বাভিমান থাকে । কর্তা ঈশ্বরকে ভুলে যান; এ জন্য সকাম কর্মের ফলাফল যাই হোক সেটি কর্তাকে ভোগ করতে হয় । এ জন্যই সকাম কর্মের ফল হয় বন্ধন । তাই অনেকেই কর্ম ত্যাগ করার পরামর্শ দেন । কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাদের যুক্তি খন্ডন করেন । তিনি শ্রীমদভগবদগীতায় উল্লেখ করেন : কর্মে বন্ধন হয় না, বন্ধন হয় কামনা বাসনার জন্য । অর্থাৎ কামনা বাসনাযুক্ত হয়ে কর্ম করলে কর্ম করলে, সে কর্মে বন্ধন হয় । কিন্তু বাসনামুক্ত হয়ে ঈশ্বরে কর্মফল সমর্পণ করে কর্ম করলে সে কর্ম হয় নিষ্কাম কর্ম অর্থাৎ কর্মযোগ । এই কর্মযোগে কর্তার কর্মফল ভোগের কোন দায়িত্ব থাকে না । এই নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমেই মানুষ মোক্ষলাভ করতে পারে ।
জ্ঞানযোগ
জ্ঞানের মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনাকে বলে জ্ঞানযোগ । জ্ঞান শব্দের অর্থ জানা । আত্মতত্ব ও পরমার্থতত্ব সম্বন্ধে যে জানা তাকেই জ্ঞান বলা হয় । আত্মতত্বের আলোকে জগতের সত্তাকে জানার নাম জ্ঞান । তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন :
" ন হি জ্ঞানেন সদৃশ পবিত্রমিহ বিদ্যতে"
গীতা- ৪/৩৮
বঙ্গানুবাদ : এই জগতে জ্ঞানের তুল্য পবিত্র আর কিছুই নেই ।
জ্ঞান লাভের উপায়
জ্ঞান লাভের ছয়টি উপায় গীতায় উল্লিখিত হয়েছে । যথা- প্রণিপাত, পরিপ্রশ্ন, সেবা, শ্রদ্ধা, তৎপরতা ও ইন্দ্রিয় সংযম । এগুলোর মধ্যে প্রথম তিনটি বহিরঙ্গ ও অপর তিনটি অন্তরঙ্গ উপায় । প্রণিপাত, পরিপ্রশ্ন ও সেবা এই তিনটিকে জ্ঞান লাভের বহিরঙ্গ সাধন বা উপায় বলা হয় । অপরদিকে শ্রদ্ধা, তৎপরতা ও ইন্দ্রিয় সংযমকে বলা হয় জ্ঞান লাভের অন্তরঙ্গ উপায় ।
প্রণিপাত
আমি হীন ৷ আমি অজ্ঞ, অক্ষম-- এরূপ উপলব্ধি থেকে উত্তরণের ইচ্ছায় আচার্য বা শিক্ষকের নিকট যে আত্মনিবেদন, তাই প্রণিপাত ।
পরিপ্রশ্ন
তত্ত্বজিজ্ঞাসু হয়ে, মুক্তিকামী হয়ে, আচার্যের নিকট জানার আকাঙ্ক্ষা নিবেদন করাকে পরিপ্রশ্ন বলে ।
সেবা
সেবা অর্থ সুখ বিধান । যে যে কর্ম করলে আচার্য সন্তুষ্ট হন, তার আজ্ঞানুবর্তী হয়ে সে সকল কর্ম করাকে সেবা বলে । সেবার মাধ্যমে সাধকের চিত্ত জ্ঞান গ্রহণের যোগ্য হয় । এভাবে বহিরঙ্গের ন্যায় অন্তরঙ্গ সাধনগুলোর পরিচয় নেওয়া যাক ।
শ্রদ্ধা
শাস্ত্র বা গুরুবাক্যে বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা বলা হয় । এই শ্রদ্ধা হচ্ছে জ্ঞান লাভের প্রথম সোপান ।
তৎপরতা
কাজের প্রতি একনিষ্ঠতাকে তৎপরতা বলা হয় । তৎপর হওয়ার অর্থ হচ্ছে, সুনির্দিষ্ট বিশ্বাসটিকে রূপ দেওয়ার জন্য গভীরভাবে একনিষ্ঠ হওয়া । একই বস্তুতে চিত্তের স্থিরতা সাধনের পক্ষে বাধা হচ্ছে অন্য বস্তুর প্রতি আকর্ষণ । তাই 'তৎপর' হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে অন্য কিছুর প্রতি মনযোগী না হয়ে একমাত্র পরমতত্ত্বে মনকে গভীরভাবে নিবিষ্ট রাখতে ।
ইন্দ্রিয় সংযম
জ্ঞান অর্জনের জন্য পঞ্চ ইন্দ্রিয়সমূহকে সংযত রাখতে হয় । ইন্দ্রিয় দমনই সাধককে ব্রহ্মজ্ঞানে পূর্ণ স্থিতি দিতে পারে ।
জ্ঞানের ফল চারটি
১. শোকাদি মোহ দূর হয়
২. সমস্ত পাপ বিনষ্ট হয়
৩. অজ্ঞানতা থাকে না
৪. জ্ঞানীর কর্মফল থাকে না
ভক্তিযোগ
ভক্তিকে অবলম্বন করে যে ঈশ্বর আরাধনা তাকে ভক্তিযোগ । যে ব্যক্তি আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ ত্যাগ করে ঈশ্বরের স্মরণাপন্ন হন তাকে ভক্তযোগী বলা হয় । ভক্তিযোগে অর্জুন ঈশ্বরকে প্রশ্ন করেছেন, নির্গুণ ব্রহ্মের সাধনা আর ব্যক্ত ঈশ্বরকে সাকাররূপে আরাধনা করার মধ্যে কোনটি উত্তম পথ । উত্তরে যোগেশ্বর বলেছেন, অর্জুন, সাধনার উভয় পথেই ক্লেশ আছে । তবে অব্যক্ত ব্রহ্মচিন্তার চেয়ে সগুণ মূর্তিমান ঈশ্বরের আরাধনা অপেক্ষাকৃত সহজ । তাই বলা যেতে পারে যারা সাকার ঈশ্বরের আরাধনা করেন তারাই মূলত ভক্তিযোগের অনুসারী ।
কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তিযোগের সমন্বয়
কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তিযোগের মধ্যে নিবিড়-নিরবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক রয়েছে । নিবিষ্টভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় যা কর্ম, তাই জ্ঞান এবং সেটাই ভক্তি । এদের পার্থক্য শুধু দেখার ধরনে । নিষ্কাম কর্ম থেকেই জ্ঞানের উদয় এবং জ্ঞানের পূর্ণতায় ভক্তির অবির্ভাব ।
অনেক সুন্দরভাবে ব্যাখ্যাইত হয়েছে
ReplyDelete