জন্মান্তরবাদ
অন্য জন্মের অর্থ জন্মান্তর । আর এই জন্মান্তর সম্বন্ধে যে দার্শনিক চিন্তাভাবনা তাকে জন্মান্তরবাদ বলে ।
এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভগবদগীতায় অর্জুনকে অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উক্তিটি প্রনিধানযোগ্য :
"বহুনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন ।
"তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেথ পরন্তপ ।।
- গীতা ৪/৫
অর্থাৎ হে অর্জুন, তোমার ও আমার বহুবার জন্ম হয়েছে । সে কথা তোমার মনে নেই, সে সবই আমার মনে আছে ।
এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ যে অর্জুনের সখা এবং তার রথের সারথী এ সত্য অতিক্রম করে আর একটি পরম সত্য প্রকাশিত হয়েছে, তা হলো শ্রীকৃষ্ণ সর্বজ্ঞ, পরমেশ্বর । তিনি শাশ্বত, অব্যয় পরমাত্মা । আবার যখন বলা হলো অর্জুনেরও বহুবার জন্ম হয়েছে, এ থেকে বোঝা যায় অর্জুনের মধ্যেও পরমাত্মার ন্যায় কোন শাশ্বত বস্তু রয়েছে যা বহুবার জন্ম-মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েও নষ্ট হয়ে যায় নি । শাস্ত্রের ভাষায় জীবদেহের ঐ শাশ্বত বস্তুটি হলো জীবাত্মা, সংক্ষেপে আত্মা ।
দেহ ও আত্মা
দেহ ও আত্মার মধ্যে রয়েছে গভীর সম্বন্ধ । দেহকে আশ্রয় করেই আত্মার অভিযাত্রা ; আবার আত্মাকে লাভ করেই দেহ সজীব । দেহহীন আত্মা নিষ্ক্রিয়, আত্মাহীন দেহ জড় । তবে দেহের মধ্যে যে আত্মার অবস্থান এটা উপলব্ধি করা সহজ কাজ নয় । আত্মা যে দেহকে আশ্রয় করে সেটি কিন্তু নশ্বর । ক্ষিতি (ভূমি), অপ (জল), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু) ব্যোম অর্থাৎ আকাশ -- এই পঞ্চভূতে গড়া হলো দেহ । এই দেহের বিনাশ আছে । যিনি জীবদেহ ধারন করে এসেছেন তারই দেহনাশ নিশ্চিত হয়ে রয়েছে । গীতায় এ সম্পর্কে বলা হয়েছে 'জাতস্য হি ধ্রবো মৃত্যুঃ'-- জাত ব্যক্তির মৃত্যু অবধারিত । তবে ঐ দেহে যে জীবাত্মা ছিল তার কিন্তু বিনাশ নেই । ঐ জীবাত্মা এক দেহ ত্যাগ করে অন্য নতুন দেহ ধারন করে ।
জন্মান্তর প্রক্রিয়া
জীবাত্মার পক্ষে মৃত্যুর অর্থ হলো দেহত্যাগ । জীবাত্মা কেমন এবং কেনইবা দেহত্যাগ করে, গীতায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে দেহত্যাগ ব্যপারটি একটি সহজ কাজ, যেমন একই দেহে বাল্য, কৈশোর, যৌবন বার্ধক্য আসে, তেমনি আত্মাও স্বাভাবিকভাবেই জীর্ণ দেহ ছেড়ে চলে যায় । যেমন লোকে পুরাতন ছিন্ন বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, সেইরূপ জীবাত্মাও জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারন করে ।
এভাবে পুরাতন দেহ ত্যাগ করে জীবাত্মা যে নতুন দেহ ধারণ করছে অর্থাৎ দেহের সাথে তার যে সংযোগ-বিয়োগ ঘটছে এটাই জন্মান্তরবাদ ।
কর্মবাদ
জন্মান্তরবাদের সাথে কর্মবাদ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত । আত্মার অবিনাশিতা ও জন্মান্তরবাদের ন্যায় কর্মবাদও সনাতন ধর্মের ভিত্তি ও প্রস্তর স্বরূপ । কর্মবাদের মূল কথা হলো বিশ্বজগৎ ঈশ্বরের এক বিরাট কর্মক্ষেত্র । এখানে জীব ভাবনা, বাসনা ও চেষ্টার দ্বারা নানা রকম কর্ম করে যাচ্ছে । আর প্রত্যেকটা কর্মের রয়েছে পৃথক পৃথক কর্মফল । সনাতন ধর্মমতে কর্ম করলেই কর্মফল উৎপন্ন হবে, আর কর্মকর্তাকে তা অবশ্যই ভোগ করতে হবে । আর এই কর্মফল ভোগ না শেষ হওয়া পর্যন্ত মোক্ষপ্রাপ্তি বা জন্ম-মৃত্যুরূপ সংসারচক্র থেকে মুক্তি হবে না ।
মুক্তির উপায়
তবে জীবের মুক্তির উপায় কি ? নিষ্কামভাবে কর্ম করলে, সে কর্মের যে ফল উৎপন্ন হবে তা আর কর্মকর্তাকে ভোগ করতে হবে না । সুতরাং নিষ্কাম কর্মের অনুশীলন করাই সঙ্গত কাজ । নিষ্কাম কর্ম করে জীব মুক্তিলাভ করতে পারে।
কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ নিয়ে আমি আগামীতে একটি পোস্টের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো ।
ততক্ষণ পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন ।
নমস্কার
জয় শ্রী রাম