যোগসাধনা এবং অষ্টাঙ্গযোগ
যোগের মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনার প্রক্রিয়াকে যোগসাধনা বলে । ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন 'যোগ' শব্দের অর্থ সংযোগ । জীবাত্মা পরমাত্মার সাথে যুক্ত হয়ে যখন সমদর্শন লাভ করে, তখনই সত্যিকারের যোগ হয় ।
মহাগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদগীতাতেও প্রায় অনুরূপ অর্থে 'যোগ' শব্দের ব্যবহার দেখা যায় । গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের ২৯ নং শ্লোকে বলা হচ্ছে :
সর্ব্বভূতস্থমানং সর্ব্বভূতানি চাত্মনি ।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্ব্বত্র সমদর্শন ।।
অর্থাৎ যোগীগণ নিজেকে সর্বজীবে সমদর্শী হয়ে আত্মাকে সর্বভূতস্থিত দেখেন, আর সর্বভূতকে আত্মাতে দর্শন করেন।
আবার মহর্ষি পতঞ্জলি বলেন, যোগের দ্বারা চিত্ত বৃত্তি নিরুদ্ধকরন বোঝায় । অর্থাৎ মনের বৃত্তিগুলোকে একান্তভাবে নিরুদ্ধ করার নামই যোগ । ধর্ম সাধনার ক্ষেত্রে যোগের গুরুত্ব অপরিসীম । আমাদের সনাতন ধর্মশাস্ত্রে যোগের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ।
যোগ দুই ভাগে বিভক্ত, যথা :
১. হঠযোগ
২. রাজযোগ
হঠযোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে শরীরকে সুস্থ, সবল ও দীর্ঘায়ু করা । কোনরূপ শক্তিকে আয়ত্ত করতে হলেই শরীরকে নিয়ন্ত্রিত করা প্রয়োজন । সাধারন লোক যোগ বলতে হঠযোগের ব্যায়াম ও আসনগুলোকে বুঝিয়ে থাকে ।
অন্যদিকে রাজযোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবাত্মাকে পরমাত্মার সাথে যুক্ত করা । আর এই পরমাত্মার সাথে যুক্ত হওয়াই হচ্ছে জীবের মুক্তি বা মোক্ষলাভ ।
তবে হঠযোগের সাথে রাজযোগের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধও রয়েছে । সাধনার পূর্ব শর্ত হচ্ছে শরীরকে সুস্থ রাখা ।
'শরীরমাদ্যং খলু ধর্মসাধনম'
শরীর ও মন সুস্থ না থাকলে জাগতিক বা পারমার্থিক কোন কর্মই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায় না ।
রাজযোগের আটটি অঙ্গ রয়েছে । যেগুলো 'অষ্টাঙ্গ' বলে । এগুলো হলো যথাক্রমে যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারনা, ধ্যান ও সমাধি । এই আটটি প্রক্রিয়া ক্রমে ক্রমে অভ্যাস করতে হয় । এগুলোর একটি আয়ত্ত হলে তবেই পরবর্তী সোপানে আরোহন করা যেতে পারে । এখন আলোচনা করব কোন পর্যায় বলতে কি বোঝায় । চলুন দেখা যাক :
যম
অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ এই পাঁচটিকে যম বলা হয় ।
নিয়ম
শৌচ, সন্তোষ, তপস্যা,স্বাধ্যায়, এবং ঈশ্বর উপাসনা এই পাঁচটি নিয়মের অন্তর্ভুক্ত । 'যম' ও 'নিয়ম' এই দুটিরই উদ্দেশ্য হচ্ছে ইন্দ্রিয় ও চিত্তবৃত্তিগুলোকে দমন করা এবং এগুলোকে অন্তর্মুখী করে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করা ।
আসন
যোগ অভ্যাস করার জন্য যেভাবে শরীরকে রাখলে শরীর স্থির থাকে অথচ কোন কষ্টের কারন ঘটে না তাকে আসন বলে । স্থির ও সুখজনকভাবে
অবস্থান করার নামই আসন ।
প্রাণায়াম
প্রাণায়ামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে প্রাণবায়ুর নিরোধ । 'প্রাণ + আয়াম = প্রাণায়াম । প্রাণ হচ্ছে শ্বাসরূপে গৃহীত বায়ু আর আয়াম হচ্ছে বিস্তার । অর্থাৎ স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে গতিরোধ করাকেই প্রাণায়াম বলে । প্রাণায়ামে শ্বাস-প্রশ্বাস বিস্তারিত ও দীর্ঘতর করা হয় । এইরকম ছন্দোবদ্ধভাবে শ্বাস গ্রহন করলে শ্বসনতন্ত্র বলিষ্ঠ হয়, স্নায়ুতন্ত্র শান্ত থাকে এবং পার্থিব আকাঙ্খা হ্রাস পায় । সাধারনত তিনটি প্রকৃয়ার মাধ্যমে প্রাণায়াম সম্পন্য হয় । এগুলো হলো রেচক, পূরক ও কুম্ভক । শ্বাস গ্রহনকে বলে পূরক, ত্যাগকে বলে রেচক এবং শ্বাস ধারনকে বলে কুম্ভক।
প্রত্যাহার
আসন ও প্রাণায়ামের দ্বারা শরীরকে নিশ্চল করলেও মনের চঞ্চলতা সম্পূর্ণ দূর নাও হতে পারে । এরূপ অবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলিকে বাহ্যবিষয় থেকে প্রতিনিবৃত্ত করে চিত্তের অনুগত করাই হলো প্রত্যাহার ।
ধারনা
কোন বিশেষ বস্তুতে বা আধারে চিত্তকে নিবিষ্ট বা আবদ্ধ করে রাখাকে ধারনা বলে । অর্থাৎ 'ধারনা' শব্দের অর্থ দ্বারালো একাগ্রতা । জগতে একাগ্রতা ছাড়া কিছুই লাভ করা যায় না । ঈশ্বরকে লাভ করতে গেলেও চিত্তকে একাগ্র করতে হয় ।
ধ্যান
যে বিষয়ে চিত্ত নিবিষ্ট হয়, সেই বিষয়ে যদি একতানতা জন্মায় তাহলে তাকে ধ্যান বলে । অর্থাৎ ধ্যান শব্দের প্রকৃত অর্থ নিরবচ্ছিন্ন গভীর চিন্তা ।
সমাধি
ধ্যান যখন গাঢ় হয় তখন ধ্যানের বিষয়ে চিত্ত এমনভাবে নিবিষ্ট হয়ে পরে যে, চিত্ত ধ্যানের বিষয়ে লীন হয়ে যায় । এ অবস্থায় ধ্যানরূপ প্রকৃয়া এবং ধ্যানের বিষয় উভয়ের প্রভেদ লুপ্ত হয়ে যায় । চিত্তের এই প্রকার অবস্থার নামই হলো সমাধি । এই সমাধি দুইরকমভাবে হয়ে থাকে, সবিকল্প ও নির্বিকল্প ।
সাধকের যখন ধ্যানের বস্তু ও নিজের মধ্যে পার্থক্যের অনুভূতি থাকে তখন সে অবস্থাকে বলা হয় সবিকল্প সমাধি । আবার সাধক যখন ধ্যেয় বস্তুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান সে অবস্থাকে বলা হয় নির্বিকল্প সমাধি । তখন সাধকের মনে চিন্তার কোন লেশমাত্র থাকে না । এই সমাধি লাভ যোগসাধনার সর্বোচ্চ স্তর এবং যোগীর পরম প্রাপ্তি ।
আবার ফিরব পরবর্তী পোস্ট নিয়ে এবং সেগুলো অবশ্যই অনেক ইন্টারেস্টিং হতে চলেছে ।
ততক্ষন সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন ।
নমস্কার ।
স্বাধ্যায় কি ?
ReplyDeleteশাস্ত্র অধ্যয়ন করাকেই স্বাধ্যায় বলা হয়ে থাকে । ধন্যবাদ প্রশ্নটি করার জন্য ...
Delete