বৈদিক সাহিত্য :
হিন্দুধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ । এই বেদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল এক ধর্ম ও বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্য । বেদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বলে এই সাহিত্যের নাম বৈদিক সাহিত্য । সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ প্রভৃতি নিয়ে বৈদিক সাহিত্য গঠিত ।
Vedas |
বেদসংহিতা :
বেদ মানে জ্ঞান । বেদ ঈশ্বরের বাণী । প্রাচীনকালে জীবন ও জগতের উৎস খুঁজতেন সাধকেরা । এদের মধ্যে যারা সত্য বা জ্ঞান এবং ঈশ্বরের মাহাত্ম্য দর্শন বা উপলব্ধি করতে পারতেন, তাদের বলা হতো ঋষি । বেদ এই ঋষিদের ধ্যানে পাওয়া পবিত্র জ্ঞান । এই জ্ঞান জগৎ ও জীবন এবং এর আদি পুরুষ বা ব্রহ্ম সম্পর্কে জ্ঞান । সত্যের স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞান । বেদ বা এই সত্য স্বরূপের জ্ঞান সৃষ্টি করা যায় না, এটি গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে ধরা দেয়। তাই বলা হয়েছে বেদ অপৌরুষেয় । এর অর্থ হলো এটি কোন ব্যক্তি প্রবর্তিত নয় । এ কথা স্বরণ রেখেই বলা হয় বেদ সৃষ্ট নয়, দৃষ্ট । ঋষিরা বেদ দর্শন করেছেন এবং এটি প্রকাশ করেছেন মাত্র ।
ঋষি মনু বলেছেন, 'বেদ অখিলধর্মমূলম । অর্থাৎ বেদ অখিল ধর্মের মূল । বেদ পাঠ করলে ধর্ম এবং ব্রহ্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায় । বিশ্বপ্রকৃতি ও জীবন সম্পর্কে জ্ঞানলাভ হয় ।
বেদের সঙ্গে দেবতার প্রসঙ্গ যুক্ত । বেদের বিষয়কে বলা হয়েছে দেবতা । ঋষিরা দেবতাদের মাহাত্ম্য তুলে ধরেছেন । বেদে তাদের স্তুতি বা প্রশংসা করা হয়েছে । ক্ষমতা, অসাধারন শক্তি ও প্রভাবসম্পন্ন দেবতার কাছে ধন সম্পদ, সুখ ও শান্তি প্রার্থনা করা হয়েছে । কখনো বা শুধু 'পুরুষ' বা ব্রহ্মের মাহাত্ম্য ব্যক্ত করা হয়েছে । কখনো বা পার্থিব কোন অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি প্রকাশ করা হয়েছে ।
বেদ গদ্য এবং পদ্য উভয় রীতিতে রচিত । ছন্দবদ্ধ রচনাকে বলে পদ্য । বেদের অনেক অংশই ছন্দবদ্ধ রচনা । এ কারনে বেদের আরেক নাম ছান্দস । বেদের বাক্যকে মন্ত্রও বলা হয়ে থাকে । ঋষিরা বেদ থেকে মন্ত্র উচ্চারণ করে ধর্মানুষ্ঠান করতেন । বৈদিক ধর্মানুষ্ঠানের পদ্ধতি ছিল যজ্ঞ বা হোমভিত্তিক । তখন বৈদিক উপাসনা রীতিতে মূর্তিপূজা ছিল না ।
ঋষিরা বৈদিক দেবতাদের তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন । মনে রাখতে হবে, এখানে দেবতা বলতে কোন আলাদা সত্তাকে বোঝানো হয় নি । দেবতা ঈশ্বরের এক একটি নাম ।
1.স্বর্গের দেবতা
2.অন্তরীক্ষলোকের দেবতা
3.পৃথিবীর বা মর্ত্যলোকের দেবতা
স্বর্গের দেবতারা পৃথিবী থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেন । যেমন : বিষ্ণু বা সূর্য ।
মর্ত্যে যে দেবতাদের দেখা যায় তাদের মধ্যে 'অগ্নি' উদাহরণস্বরূপ হতে পারে ।
অন্তরীক্ষলোকের দেবতারা স্বর্গ এবং মর্ত্যের মাঝখানে অবস্থান করেন । যেমন : ইন্দ্র বা বায়ু ।
অগ্নিকে মর্ত্যে বা পৃথিবীতে দেখতে পাওয়া যায় ।তাই অগ্নিকে আহ্বান করে আনা হয় ।
এখানে আহ্বান বলতে প্রজ্বলিত করাকে বোঝানো হয়েছে ।
অগ্নির মাধ্যমেই অন্যান্য দেবতাদের আহ্বান করা হয় । অগ্নি প্রজ্বলিত করে, বেদের মন্ত্র উচ্চারণ করে আহ্বান জানানো বা প্রার্থনা করাকেই বলা হয় যজ্ঞ ।
বেদে বেশিরভাগ অংশেই রয়েছে যজ্ঞে ব্যবহার করার মন্ত্র । এছাড়াও রয়েছে গান ।
এই গীত বেদের বাক্যে সুর আরোপ করে গাওয়া হতো । এই গানকেই সংস্কৃত ভাষায় বলে সাম ।
বেদ বহুকাল অবিভক্ত ছিল । পরবর্তীকালে মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদকে চারটি ভাগে বিভিক্ত করেন ।
যথা :
১. ঋগ্বেদ
২. সামবেদ
৩. যজুর্বেদ
৪. অথর্ববেদ
মহর্ষি ব্যাসদেব বেদকে বিভক্ত করেন বলেই তার নাম হয় বেদব্যাস । বেদব্যাস মহাভারতসহ আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন । যা এখনও আমাদের কাছে অমৃত আশীর্বাদস্বরূপ ।
ঋগ্বেদ :
ঋক্ শব্দের অর্থ স্তুতি । স্তুতি সম্পর্কে বিস্তারিত সংকলন হলো ঋগ্বেদ সংহিতা । ঋগ্বেদে ১০৪৭২টি মন্ত্র আছে । এখানে কয়েকটি মন্ত্র নিয়ে এক একটি বড় আকারের কবিতা বানানো হয়েছে । এ রকম এক একটি কবিতাকে বলা হয়েছে সূক্ত । কয়েকটি সূক্ত নিয়ে গঠন করা হয়েছে একটি অনুবাক । আবার কয়েকটি অনুবাক নিয়ে গঠন করা হয়েছে এক একটি মন্ডল । সমগ্র ঋগ্বেদ এরূপ ১০টি মন্ডলে বিভক্ত ।
ঋগ্বেদকে অবশ্য আরেকটি পদ্ধতিতেও বিভক্ত করা হয়েছে । যেখানে সমগ্র ঋগ্বেদ ৮ টি সমান ভাগে বিভক্ত । তবে মন্ডল পদ্ধতি বেশি প্রচলিত ।
ঋগ্বেদ যে সকল ঋষিরা দর্শন করেছিলেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন ঋষি বামবেদ, বিশ্বামিত্র, গৃৎসমদ, অত্রি, ভরদ্বাজ, কণ্ব, বশিষ্ঠ প্রভৃতি ।
সামবেদ :
পূর্বেই বলেছি, সাম অর্থ গান । ঋষিগণ যে মন্ত্রগুলোকে আবৃত্তি না করে সুর করে উচ্চারণ করতেন তার বেশিরভাগই এই সামবেদে স্থান পেয়েছে । সামবেদে মোট ১৮১০টি মন্ত্র রয়েছে । এগুলোর ৭৫টি ছাড়া বাকি সবগুলোই ঋগ্বেদ থেকে নেওয়া ।
পার্থক্য হচ্ছে এই যে, ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলো শুধু আবৃত্তি করা হতো, আর সামবেদের মন্ত্রগুলো সুরারোপিত সুর সহযোগে গাওয়া হতো ।
যজুর্বেদ :
'যজুঃ' বলতে যজ্ঞের মন্ত্র বোঝায় । তার জ্ঞানকে বলা হয় যজুর্বেদ । আর এই জ্ঞানের সংকলনই হলো যজুর্বেদসংহিতা । ঋগ্বেদ ও সামবেদ পদ্মে রচিত । কিন্তু যজুর্বেদে গদ্য ও পদ্য উভয় রীতির মন্ত্রই পাওয়া যায় । যজ্ঞানুষ্ঠানের নিয়ম ও পদ্ধতি যজুর্বেদে সংকলিত হয়েছে ।
যজুর্বেদ প্রধান দুই ভাগে বিভক্ত । যথা :
১. কৃষ্ণ যজুর্বেদ
২. শুক্ল যজুর্বেদ
কৃষ্ণ যজুর্বেদের অপর নামই হলো তৈত্তিরীয় সংহিতা । আর শুক্ল যজুর্বেদের অপর নাম বাজসনেয়ী সংহিতা । কৃষ্ণ যজুর্বেদে ৭টি কান্ড এবং ২১৮৪টি কন্ডিকা বা মন্ত্র রয়েছে । অপরদিকে শুক্ল যজুর্বেদে ৪০টি অধ্যায় এবং ১৯১৫টি মন্ত্র রয়েছে ।
অথর্ববেদ :
অথর্ববেদ সংহিতায় বিভিন্ন বিষয়ক মন্ত্র সংকলিত হয়েছে । ভেষজ বিদ্যা, মাঙ্গলিক ক্রিয়াকান্ড প্রভৃতি
অথর্ববেদের বিষয়বস্তু । অথর্ববেদের আদি নাম অথর্বাঙ্গিরস । অথর্ববেদে ২০টি কান্ড, ৭৩১টি সূক্ত এবং প্রায় ৬০০০ মন্ত্র রয়েছে ।
বেদ কিন্তু প্রথমে লিপিবদ্ধ হয় নি । গুরু-শিষ্য পরম্পরায় শুনে শুনে বেদ মনে রাখা হতো । সে কারনে বেদের আরেক নাম শ্রুতি !
ব্রাহ্মণ :
বেদের দুইটি অংশ । মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ বেদের যে অংশে মন্ত্রের ব্যাখ্যা এবং বিভিন্ন যজ্ঞে তাদের বিনিয়োগ বা ব্যবহারের কথা আলোচিত হয়েছে তাকে 'ব্রাহ্মণ' বলা হয় । ব্রাহ্মণগুলো গদ্যে রচিত ।
ব্রাহ্মনের বিষয়বস্তু হচ্ছে বিধি অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ কর্ম অনুষ্ঠানের নির্দেশ, বেদমন্ত্রের অর্থ প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা, বিরোধী মতের সমালোচনা, যজ্ঞের ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় কৃতকর্মের প্রশংসা, দৃষ্টান্ত হিসেবে পূর্ববর্তীকালে অনুষ্ঠিত বা সম্পাদিত যজ্ঞের উল্লেখ প্রভৃতি । ব্রাহ্মণগুলোর মধ্যে রয়েছে ঐতরেয়, কৌষীতকী, পঞ্চবিংশ, শতপথ, গোপথ ইত্যাদি ।
এক এক সংহিতার সাথে যথাক্রমে এক একটি ব্রাহ্মণ আরণ্যক ও উপনিষদ যুক্ত । নিম্নে একটি ছকের আকারে সংহিতা এবংং তাদের সঙ্গে যুক্ত ব্রাহ্মণ ও উপনিষদের নাম উল্লেখ করা হলো :
'বেদ অখিলধর্মমূলমঃ'
হিন্দুগণ অবশ্যই মনে রাখবেন, আমরা যে ধর্মপালন করি তার মূলেই কিন্তু বেদ । তাই বেদ কে ভুলে গেলে চলবে না । হিন্দু ধর্ম আজ বেদ থেকে দূরে সরে গেছে বলেই আজ বিলুপ্তির পথে ধাবিত হচ্ছে ।
নমস্কার
অনেক কিছু জানতে পারলাম।।
ReplyDeleteদাদা নমস্কার
Tnx Bro
Deleteঅনেক কিছু জানতে পারলাম ।খুব ভালো লাগল ।মন খুশিতে ভরে গেলো ।
ReplyDeleteএটাই তো চাই দাদা ❤️
Delete